কত দূর গেলে একজন শিক্ষককে ভয় লাগে

টেলিফোন নিয়ে নানা রকম রসিকতা আছে। আমাদের দেশে সবচেয়ে চালু এবং পুরনো রসিকতাটা ছিল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওই যে টেলিফোনে একজন একদিক থেকে বলছে, হ্যালো; অন্যজন উত্তর দিচ্ছে, হেলছি তো। আবার হ্যালো, ওদিকে হেলছি। শেষে হ্যালো-হ্যালোতে বিরক্ত হয়ে বলল, আর হেলতে পারব না। হেলতে হেলতে শুয়ে পড়েছি।

তখনকার সময়ে খুব জনপ্রিয় কৌতুক ছিল। এখনকার সময়ে পুরনো ধাঁচের মনে হতে পারে। তবে চার্চিলের কোনো গল্প কখনোই পুরনো হওয়ার নয়। তাঁর টেলিফোনের গল্পটি আজও তাই আধুনিক।

তিনি তখন প্রধানমন্ত্রী। পাশের ঘরে তাঁরই কোনো কর্মী প্রচণ্ড চিৎকার করে টেলিফোনে কথা বলছিলেন। চার্চিল জানতে চাইলেন, ‘ও এত চেঁচিয়ে কথা বলছে কেন?’

কেউ একজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাল, ‘উনি স্কটল্যান্ডে কথা বলছেন।’

চার্চিল বললেন, ‘ওকে টেলিফোন ব্যবহার করতে বলো।’

টেলিফোন নিয়ে এ রকম আরো বহু গল্প আছে। হ্যাপাও ছিল। ক্রস কানেকশন-রং নাম্বার। সেগুলো থেকে প্রেমের সম্পর্কের নানা সূত্রও তৈরি হতো।

সে আদি যুগের কথা। আধুনিক যুগে সেই টেলিফোন মৃতপ্রায়। এখন মোবাইলের যুগ। প্রথম মোবাইল আসার পর যে শান্তিটা লাগল, যাক এখন আর টেলিফোনে টেপাটেপি করে আঙুলে ব্যথা করতে হবে না। এনডাব্লিউডি-আইএসডি কলের জন্য অপারেটরকে তেল দেওয়ার দিনও শেষ। কিন্তু তখন কি আর জানতাম, একদিন এই মোবাইলেই ঢুকে যাবে জীবন। মোবাইলে কথাবার্তা সব যথেচ্ছ রেকর্ড করা যাবে। এবং যথেচ্ছ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে।

ইসরায়েলি কম্পানি আবার পেগাসাস নামের এমন জিনিস আবিষ্কার করেছে যে দূরে বসেই আপনার ফোনে ঢুকে যাবে। আপনি টেরও পাবেন না যে আপনার কথা-কাজ সব পুরো দুনিয়ার জ্ঞাতব্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা নিয়ে পুরো দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কিন্তু সে রকম হৈচৈ নেই। কারণ কি এটাই যে, আমাদের মানুষ দেখেছে, ওটা আবিষ্কৃত হওয়ার আগেই এ দেশে মানুষের একান্ত কথাবার্তা টিভি-পত্রিকা প্রকাশ করে বসে; বরং পেগাসাস একদিক থেকে তো ভালো। বড় মানুষদের ফোন টেপ করা হচ্ছে। হয়তো সেই দিন আসবে যে সেগুলোও আমরা শুনতে পাব। এক অদ্ভুত আনন্দ সম্ভাবনায় বরং হয়তো তারা শিহরিত।

মানুষের একান্ত আলাপ বিষয়টি খুব অদ্ভুত। প্রায় সবাই গোপনীয়তার পক্ষে; কিন্তু আবার অন্য কারো গোপন কিছু বেরিয়ে গেলে সেটা শুনতে বা জানতে সবারই দারুণ আগ্রহ। কাজেই এগুলো ভাইরাল হয়ে যায়। আর ভাইরাল হওয়া জিনিস থেকে দূরে থাকলে মিডিয়াও মানুষ থেকে পিছিয়ে পড়ে বলে তারাও শামিল হয়ে যায়। সত্যিই একজনের কণ্ঠ কি না, কোন উদ্দেশ্যে কে ছড়াল—এসব স্বাভাবিক প্রশ্ন সেই উত্তেজনা আর কৌতূহলের ঝড়ে হাওয়া। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ফোনালাপ শোনা যায়, সেগুলোর ভিত্তিতে শাস্তি বা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া এর একটা সামাজিক স্বীকৃতির পথ তৈরি করেছে। ফলে যে কেউ যে কারোটা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্র বা সমাজ নিজেরা সেই অপরাধ করছে বলে আর শাসনের জায়গায় নেই। মিলিয়ে একটা জট পাকানো অসুস্থ অবস্থা। আপাতত মুক্তির কোনো উপায় দেখি না। দেখি না যখন-তখন রসিকতা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে।

এটাও পুরনো আমলেরই গল্প। অ্যানালগ ফোন আমলের গল্প। তখন সরাসরি লাইন পাওয়া যেত না। যোগাযোগ করতে হতো অপারেটরের সঙ্গে। অপারেটর ওই নাম্বারে ধরিয়ে দিতেন। তো একবার এক ছোট্ট শহরে অদ্ভুত এক সমস্যা দেখা দিল। শহরে অল্প কয়েকটা টেলিফোন, শ দেড়েক, নাম্বার এক থেকে দেড় শর মধ্যে। তো দেখা গেল, ১০০-এর পর কোনো নাম্বার আর পাওয়া যায় না। অপারেটর সব সময় বলে, ‘নাম্বারটা ব্যস্ত আছে।’

এক দিন ব্যস্ত থাকতে পারে। তাই বলে রোজ। কিছু মানুষের সন্দেহ হলো। একদিন তারা হানা দিল টেলিফোন অফিসে। আবিষ্কৃত হলো যে এক শর পরের নাম্বারগুলো বোর্ডের একটু ওপরে। ফলে এই নাম্বারে সংযোগ দিতে হলে অপারেটরকে সিট থেকে উঠে দাঁড়াতে হয়। তিনি সেই কষ্ট করতে চান না। বলে দেন, নাম্বার ব্যস্ত।

ছোট শহরে যেকোনো অনিয়মের প্রতিবিধানের একটা আঞ্চলিক ব্যবস্থা আছে। উত্তেজিত জনতার হাতে উত্তম-মধ্যম। সে রকম ব্যাপারই ঘটল।

তখন মনে হতো, টেলিফোনের এই দুর্যোগ কবে কাটবে। সত্যি বললে, ২০ বছরের মধ্যে এত উন্নতি আমরা ভাবিনি। একেবারে অপারেটরের হাতে থাকা অ্যানালগ ফোন যে আমাদের হাতে এসে এমন পাখা গজিয়ে যাবে কল্পনাও করিনি। কল্পনাও করিনি কয়েকটা টিপে সুদূর আমেরিকায় কথা বলা যাবে ন্যায্য মূল্যে বা বিনা মূল্যে। তখন এটা কেউ বললে মনে হতো, স্বপ্নের কথা বলছে। স্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটল। কিন্তু তাতে যে এভাবে দুঃস্বপ্নও যোগ হবে কে জানত।

ফোন নিয়ে অনেক হলো। চাইলে আরো গল্প করা যাবে। থাক, বরং শিক্ষকদের নিয়ে দু-একটা গল্প শুনি। এই ফোনালাপের ভিত্তিতে শিক্ষককে দায়ী করার সুযোগ নেই; কিন্তু প্রশ্ন তো থাকেই। এর বাইরেও বিস্তর অভিযোগ শিক্ষকদের নামে। সেই ফেনীর মাদরাসাছাত্রী হত্যা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এমন এমন ঘটনা বেরোচ্ছে যে ভরসার ক্ষেত্রটা ক্রমেই সংকুচিত।

একজন শিক্ষক বদলি বা অন্য কোনো কারণে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন সহকর্মী তাঁকে তুলে দিতে এসেছেন। বিদায়ি সম্ভাষণ শেষে ট্রেন ছাড়ল। তারপর একজনকে দেখা গেল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে। কেউ একজন জানতে চাইল, ‘স্যার, সবাই চলে গেল। আপনি গেলেন না যে…’

‘সমস্যা হয়েছে কি, আমারই আসলে যাওয়ার কথা ছিল। ওরা এসেছিল আমাকে তুলে দিতে। কিন্তু ওরা ট্রেনে চেপে বসাতে আমি ভাবলাম, বোধ হয় ওদেরই যাওয়ার কথা।’

‘বলেন কী?’

‘এখন মনে পড়ছে আমার যাওয়ার কথা ছিল। ভালো মুশকিল হলো।’

‘কী আর করা, আপনি তাহলে বাসায় চলে যান। পরের ট্রেনে না হয়…’

‘তা করা যায়; কিন্তু বাসায় গিয়ে কী হবে, আমার জিনিসপত্রও যে সব ওরা নিয়ে গেছে।’

অনেকের কাছে বেখেয়ালির গল্প। কিন্তু এটা সেই শিক্ষকদের গল্প, যাঁরা আসলে জাগতিক বিষয়ে খুব উদাসী ছিলেন। ধ্যান-জ্ঞান ছিল একটাই। পড়ানো। শেখানো। সমাজ আর জগতে আলো জ্বালানো। এই বিশেষ নির্লোভ বোধে কিভাবে নিজেদের আবদ্ধ রাখতেন এঁরা? কারণ কি এটাই যে, তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হতো না! নইলে অভাব-অনটন এসব তো তখনো ছিল। এই চাকরি কোনো দিনই আকর্ষণীয় ছিল না। এখন বরং কোথাও কোথাও যথেষ্ট অর্থকড়ি মেলে। কখনো কখনো আবার পুরনো কথাটা মনে হয়, অর্থই কি অনর্থের মূল? প্রচুর সুযোগ আর সম্ভাবনায় সমাজের আর দশটা ক্ষেত্রের সঙ্গে স্রোতে মিশে গেছেন বলে আলাদা নৈতিকতার চর্চাটাই আর নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নামজাদা এক শিক্ষক নিজের গলিতে এসে আশপাশের সবাইকে নিজের নাম ধরে বলতেন, অমুকের বাসা কোনটা বলেন তো। খুব বিখ্যাত মানুষ বলে এলাকার সবাই তাঁর বাসা চিনত। দেখিয়ে দিত। তিনি বাসায় ঢুকতেন। সেই মানুষটি কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে কিংবদন্তি।

আমাদের চেনা এক স্যার ছিলেন। নিজের বাসা থেকে স্কুলের ভাড়া একসময় ছিল দুই টাকা। সময়ে সেটা বেড়ে তিন-চার-পাঁচ-দশ টাকা হয়। কিন্তু স্যার অনড়। বাসা থেকে বেরিয়েই জিজ্ঞেস করেন, ‘এই রিকশা যাবে? অমুক স্কুল।’

‘যাব।’

‘ভাড়া কত?’

‘পাঁচ টাকা।’

‘না, দুই টাকা।’

দুই টাকায় কেউ রাজি হয় না। স্যার হাঁটতে থাকেন। পথ চলতি রিকশাওয়ালাদের থামান, ‘অমুক স্কুলে যাবে? দুই টাকা হলে চলো।’

অযৌক্তিক ভাড়ায় কেউ রাজি হয় না। তিনি হাঁটতে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দুই টাকা দূরত্বে চলে আসেন। তখন রিকশা মেলে। তিনি মহানন্দে তাতে চেপে বসেন। সারা জীবন তিনি এভাবেই দুই টাকায় চালিয়ে গেছেন।

এই গল্প ছড়িয়ে গেল। হাসাহাসিও হলো। দুষ্টু ছাত্ররা একদিন সুযোগমতো বলল, ‘স্যার, ভাড়া কিন্তু এখন পাঁচ টাকা হয়ে গেছে। আপনি পেছনে রয়ে গেছেন।’

স্যার হাসলেন, ‘বাবা রে, আমার আগানোর দরকার নেই। আমি আমার জায়গায় থাকি। তোরা সবাই আগা। আমার কাজ তোদের এগিয়ে দেওয়া। শিক্ষকরা পেছনে থাকবে। ছাত্ররা সময়ের সঙ্গে আগাবে, এটাই নিয়ম।’

এখন আর কেউ পেছনে থাকতে চাচ্ছেন না। কেউ কেউ এত দূর এগোচ্ছেন যে তাঁদের কথা শুনে, কাণ্ড দেখে ভয় লাগে। একটা সমাজে শিক্ষক যখন শ্রদ্ধার জায়গা থেকে ভয়ের জায়গায় যান তখন সেই সমাজে দুটো ঘটনা ঘটে। পতন এবং পচন।

আমরা বোধ হয় পতনের পথে। পচনের গন্ধ চার দিকে।

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ