‘এ বছর ঢাকার মানুষের একদিনের জন্যও নির্মল বায়ূ সেবনের সৌভাগ্য হয়নি’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ 

দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাঁচ, ধোঁয়া বা ধুলা, যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি বলা হয়, সূক্ষাতিসূক্ষ ‘বস্তুকণা ২.৫‘। যেটি মানুষের চুলের ব্যাসের মাত্র তিন শতাংশ, যেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। এই দূষণ সবচেয়ে বেশি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে যা মূলত গাড়ির ইঞ্জিন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়।

গবেষকরা বলছেন, যে হারে বাতাস দূষিত হয়েছে। তাতে এই বছর ঢাকার মানুষের একদিনের জন্যও ভালো বায়ূ সেবনের সৌভাগ্য হয়নি।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের বাতাসে এই বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি।

তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষস্থানে মধ্যে ঘুরাফেরা করছে। আর দিল্লির পর রাজধানী হিসেবে ঢাকা দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে।

এই বিষয়গুলো বারবার দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তুলে ধরছেন। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে স্ট্যামফোর্ড বায়ূম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জানান, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড়ে বায়ূ দূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে ২৫ দিনের গড় বায়ুমান সূচক ২১৯ দশমিক ৫২তে এসে দাঁড়ায়।

তিনি জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে ঢাকার মানুষ একদিনের জন্যও ভালো বায়ূ সেবন করতে পারেনি।

ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকার মধ্যে তেজগাঁও (প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে বস্তুকণা ছিল ৭০ মাইক্রোগ্রাম), শাহবাগ (প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণা ছিল ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)। আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এই এলাকাগুলোর বায়ুতে গড় বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১, ৬৬ এবং ৬৫ মাইক্রোগ্রাম।

গবেষকরা বলছেন, আমাদের বায়ু দূষণে ৬০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় রাতের বেলা। রাতের ১২ ঘণ্টায় ৬০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় আর বাকি ৪০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় দিনের বেলা। রাতে বায়ুর চাপ বেড়ে যায়। ওপর থেকে বায়ু নিচের দিকে চাপ দেয়। রাতে তাপমাত্রা কমে যায় এবং কুয়াশা পড়ে, এ কারণে আকাশ ভেজা ভেজা থাকে। দিনের বেলায় বায়ু প্রবাহের গতি বেশি থাকে রাতে কম থাকে। এসব কারণে ধুলাবালি নিচের দিকে থাকে। ফলে রাতে বায়ু দূষণ বাড়ে।

স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার‘ সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। যার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে।

বায়ুদূষণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা গেছে ১২ লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগ, স্ট্রোক, চোখে ছানি পড়া, শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সমস্যা হতে পারে।

স্টেট অব গ্লোবাল বলছে, বায়ূদূষণ রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূ বাড়বে এক বছর তিন মাসের বেশি।

গবেষকদের মতে, বায়ুদূষণ কমাতে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে।

জলবায়ু পরির্বতন ও বায়ুদূষণ রোধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা, কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা, এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা, প্রচুর বনায়ন করা, নির্মাণকাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা, শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দু থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছেটানোর ব্যবস্থা করা, অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, গাছ লাগানো, ছাদবাগানে উৎসাহিত করা, জলাধার সংরক্ষণ সেই সঙ্গে নির্মল বায়ু আইনের বাস্তবায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে বাজেটের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি কাজ করতে হবে বলে জানাচ্ছেন বায়ূ দূষণ নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।

 

সূত্রঃ যুগান্তর