এসিআই’র আগাছা দমনের বিষ দিয়ে মাথায় হাত গোদাগাড়ীর কৃষকদের

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রায় ৪৫ দিন আগে বর্গা নেওয়া জমিতে ধানের চারা রোপন করেছিলেন গোদাগাড়ীর বিজয় নগর গ্রামের আদর্শ কৃষক বিপ্লব হোসেন; কিন্তু কয়েকদিন পরে জমিতে ধানের সঙ্গে জন্ম নেয় আগাছা। সেই আগাছা দমনের জন্য বাজার থেকে এসিআই কম্পানীর ‘জাম্প’ নামের বিষ কিনে এনে জমিতে স্প্রে করেন তিনি। এরপর যথা নিয়মে জমির ধানের পরিচর্যা করতে থাকেন; কিন্তু দিন যায় মাস যায় জমির ধানগাছ আর বাড়তে থাকে না।

উল্টো ধানগাছগুলো লালচে আকার ধারণ করে ধিরে ধিরে মরতে শুরু করে। আবার যেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোও যেন দুর্বল প্রকৃতির হয়ে আছে। এই অবস্থায় ধানগাছ বাঁচাতে একের পর এক সারসহ নানা পরিচর্যা করে চলেছেন কৃষক বিপ্লব; কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো দিনের পর দিন ধানগাছগুলো মরেই যাচ্ছে। এই অবস্থায় যেন মাথায় হাত পড়েছে ওই কৃষকের।


সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু এই কৃষকেরই নয়, এবার চলতি মৌসুমের ইরি-বোরোর জমিতে আগাছা দমনের জন্য এসিআই কম্পানীর ‘জাম্প’ নামের বিষ প্রয়োগ করে গোদাগাড়ী উপজেলার শতাধিক কৃষককের অন্তত তিন শ বিঘা জমির ধান মরে যাচ্ছে।

ধানগাছগুলোর এমন দশা হয়ে আছে যে, বিঘা প্রতি কোনো কোনো জমিতে এক মণ ধানও উৎপাদন হবে না। আবার কোনো কোনো জমিতে ধানগাছ মরে একেবারে সাবাড় হতে চলেছে। এই অবস্থায় দিশাহীন হয়ে পড়েছেন ধানচাষিরা। যাদের প্রায় নব্বই ভাগই বর্গাচাষি। জমি মালিককে বিঘা প্রতি চার মণ হারে ধান দেওয়ার শর্তে ইরি-বোরো ধান চাষ করেছেন এসব কৃষকরা। অথচ ধানের যে অবস্থা তাতে বর্গদারকে চার মণ ধান দেওয়া তো দূরের কথা গভীর নলকূপ থেকে পানি সেচ দেওয়ার যে খরচ, সেটিও তুলতে পারবেন না কৃষকরা-এমনটিই আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

গত বুধবার উপজেলার দেউপাড়া ইউনিয়নের বিজয়নগর কলোনী মাঠে গিয়ে দেঘা যায়, কিছু জমিতে যেন সবুজের সমাহার, তো পাশেই কিছু কিছু জমিতে ধানগুলো মরে পানির সঙ্গে মিশে আছে। আবার কিছু কিছু জমিতে ধানগুছলো কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে। একই বিলে এমন বিচিত্র আকারের ধানগাছ এর আগে কখনোই দেখেননি ওই এলাকার চাষিরা। প্রতিবছরই একই সময়ে পাশাপাশি জমিতে ধানচাষ করেছেন। আবার একই প্রতিটি জমির ধানগাছুগুলোও ছিল একই অবস্থা। যেদিকে তাকানো যেত দু’নয়ন জুড়িয়ে যেত। অথচ কৃষকদের র একদিকে তাকালে নয়ন জুড়িয়ে যাচ্ছে, তো আরেক দিকে তাকালে চোখে জ্বল নেমে আসছে ধানগাছগুলোর বেহাল দশা দেখে।

বিজয় নগর গ্রামের কৃষক বিপ্লব হোসেন জানান, তার নিজস্ব তেমন জমি নাই। সেই ছোট থেকেই বাব-দাদার সঙ্গে বর্গাচাষি হয়ে জমিতে ধানচাষ করে যাচ্ছেন। তাঁর জমির ধান দেখে অন্য কৃষকরাও অনুপ্রাণিত হোন; কিন্তু এবার সেই কৃষকের মাথায় যেন হাত পড়েছে জমিতে আগাছা দমনে ব্যবহৃত বিষ প্রয়োগের ফলে। প্রায় ৯ বিঘা জমির ধানগাছই এবার সাবাড় হতে চলেছে আগাছা দমনের বিষ প্রয়োগের ফলে।


বিপ্লব হোসেন জানান, জমিতে ধানের চারা রোপনের পর নতুন করে শেকড় গোঁজাতে থাকে। এরপর দিনের পর দিন বীজগুলো বাড়তে থাকে; কিন্তু এবার বীজ রোপনের পর ১০ দিনের মাথায় আগাছা দমনের জন্য এসিআই কম্পানীর ‘জাম্প’ নামের বিষ প্রয়োগ করে নতুন করে আর শেকড় গোঁজায়নি। এমনকি আগের শেকড় মরে যাচ্ছে বা মরে গেছে। এই অবস্থায় ধানগাছ বাড়ছে না। ফলে মরে মাটিতে বসে যাচ্ছে, অথবা কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় নতুন করে জমিতে আর বীজ রোপনেরও সময় নাই। অপরদিকে ধানচাষ করতে যে টাকা খরচ হয়েছে বা হচ্ছে এবার তা সবই জলে যাবে ধানগাছ মরে যাওয়ার কারণে।

একই বিলের আরেক চাষি হালিম জানান, তিনি এবার ১৮ বিঘা জমিতে ইরি-বোরো চাষ করেছেন। তিনিও বিঘা প্রতি চার মণ ধান দেওয়ার সর্তে জমি বর্গা নিয়ে ধানচাষ করেছেন। তাঁর জমিগুতেও একইভাবে ধানগাছগুলো মরে যাচ্ছে বা মরে গেছে। এই অবস্থায় দিশাহীন হয়ে পড়েছেন কৃষক হালিম।

তিনি বলেন, ১৮ বিঘা জমিতে বর্গাদারকে শুধু ধান দিতে হবে ৭২ মণ। এরপর বিঘা প্রতি ধানচাষের জন্য আরও অন্তত ৯ হাজার টাকা করে খরচ হবে; কিন্তু এবার ধানগাছের যে অবস্থা-তাতে বর্গদারকে কি দিব-আর নিজে কি খাবো বুঝে উঠতে পারছি না। ধানচাষ করতে গিয়ে যে ঋণ-দেনা হচ্ছে-এই টাকা কোথায় থেকে দিব-সেটি নিয়েই এখন চিন্তাই আছি।’

হালিম বলেন, এসিআই কম্পানীর ‘জাম্প’ নামের আগাছা দমনের বিষ প্রয়োগ করেই আমার জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এর ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছেও আমরা অভিযোগ করেছি। তার পরও ক্ষতিপূরণ না পেলে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা মামলা করব। কারণ ক্ষতিপূরণ না পেলে আমরা নি:স্ব হয়ে যাব।’

বান্দুড়িয়া হাজিপুর গ্রামের কৃষক রাকিবুল বলেন, ‘আমিও বর্গা নিয়ে তিন বিঘা জমিতে ধানচাষ করেছি। হামার জমির ধানগাছগ্যুলোও ম্যরে য্যাচ্ছে। আমার জমি থ্যাকে পাশের জমিতে পানি যাওয়ায় ওই জমিরও ধানগাছ ম্যরে য্যাচ্ছে। আমরা এই ক্ষতি পূরণের দাবি জানাচ্ছি।’

জানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এসিআই কম্পানীর আগছা দমনের বিষ প্রয়োগ করেই গোদাগাড়ীর কয়েটি বিলের কয়েক শ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ওই কম্পানীর প্রতিনিধিদের ডেকে বিষয়টির সমাধান করতে বলেছি। তারা আমাদের নিকট থেকে কয়েকদিন সময় নিয়েছে। তারা কিভাবে বিষয়টির সমাধানের উদ্যোগ নিবে-সেটি দেখার বিষয়। তবে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের যেভাবেই হোক ক্ষতি পুশিয়ে দিতে হবে। তা না হলে এই কৃষকরা বড় ধরনের ক্ষতিরমুখে পড়বে। এটি হতে দেওয়া যাবে না।’

স/আর