এমপির ডিও জালিয়াতি করে টিকেট ক্রয় : ঘটনা তদন্তে পশ্চিম রেলের ৩ সদস্যের কমিটি


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর-০৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আয়েন উদ্দিনের চাহিদাপত্র (ডিও) জালিয়াতি ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আজ বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ডেপুটি চীফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (ডিসিসিএম) গৌতম কুমার কুণ্ডকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোহা. মেহেদী হাসান স্বাক্ষরিত এক দপ্তরাদেশে (চিঠি) কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়। চিঠিতে আগামী ৪ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ডেপুটি চীফ অপারেটিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট (ডিসিওপিএস) হাসিনা খাতুন ও ভিভিশনাল সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার-ডিএসই (সদর) তানিম ইকবাল।

তদন্ত কমিটি গঠনের ওই অফিস আদেশে বলা হয়- দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘এমপির ভুয়া ডিওতে ট্রেনের ডাবল কেবিন বরাদ্দ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। রাজশাহী স্টেশনে সংঘটিত বিব্রতকর এ ঘটনাটি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। অফিস আদেশে তদন্ত কমিটিকে ৫টি বিবেচ্য বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তা হলো- সংবাদটির সঠিকতা যাচাই; ডিও লেটারটি এমপি আয়েন উদ্দিন ইস্যু করেছেন কিনা; ডিও লেটারের বিপরীতে বর্তমান টিকেট ইস্যু পদ্ধতি; ভুয়া ডিও লেটারের এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ (বিশেষ করে রেলওয়ের কোন কর্মকর্তা/কর্মচারী জড়িত আছেন কিনা) এবং ভুয়া ডিও লেটার রোধে সুপারিশমালা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- সম্প্রতি (২২ আগস্ট) রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের এমপি আয়েন উদ্দিনের নামে ভুয়া আধা-সরকারি (ডিও) চিঠি দিয়ে ট্রেনের টিকিট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের গ্রেড-২-এর পার্সেল সহকারী ও রেলওয়ে শ্রমিক লীগের ওপেন লাইন শাখার সাধারণ সম্পাদক আকতার আলী এই ভুয়া ডিও লেটারটি গত রবিবার (২১ আগস্ট) রাত ১১টায় স্টেশনের বুকিং সহকারী ফয়সাল কবিরের কাছে দিয়ে যান। এমপির প্যাডে ওই ডিওতে লেখা ছিল- পরিবার নিয়ে এমপি ঢাকা যাবেন। তাই একটি ডাবল কেবিনের টিকিট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তিনি জোর সুপারিশ করেছেন। এতে এমপির স্বাক্ষর ও সিলও ছিল।

এই ডিও পাওয়ার পর রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিন গত সোমবার (২২ আগস্ট) রাতের ঢাকা-রাজশাহী রুটের ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ক’ বগির ৭,৮, ৯ ও ১০ নম্বর আসনের ডবল কেবিনের টিকিট বরাদ্দ করেন। এসব টিকিট রাখা হয় ৭ নম্বর কাউন্টারের আবদুর রশিদ নামের আরেক বুকিং সহকারীর কাছে। সোমবার রাতে যাত্রার আগে এক ব্যক্তি ওই টিকিট নিতে কাউন্টারে আসেন। এ সময় রেল শ্রমিক নেতা আকতার বুকিং সহকারী আবদুর রশিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ওই টিকেটগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এরপর এমপি আয়েন উদ্দিন পরিবার নিয়ে আসছেন বলে স্টেশনে প্রস্তুতি রাখা হয়। ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় কেবিনটি। উপস্থিত থাকেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম অসীম কুমার তালুকদারও। কিন্তু দেখা যায়, যাত্রা শুরুর আগেও এমপি আসছেন না।

এরই মধ্যে প্রধান বুকিং সহকারী আবদুল মোমিন ফোন করেন এমপির পিএস ইকবাল হোসেনকে। এমপির সঙ্গে কথা বলে ইকবাল জানান, আগের দিনই এমপি ঢাকা থেকে ফিরেছেন। আবার যাওয়ার জন্য তিনি কোনো ডিও দেননি। এটি ভুয়া। এর মধ্যে ট্রেনের যাত্রা শুরুর সময় হলে দেখা যায়, ওই কেবিনে গিয়ে উঠছেন তিন ব্যক্তি। ওই তিন যাত্রীর মধ্যে মোহনপুরের কেশরহাট পৌরসভার মেয়র (এমপির বন্ধু) মো. শহিদুজ্জামান ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য শফিকুল ইসলামও ছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান বুকিং সহকারী আব্দুল মোমিন বলেন, ‘ডিও লেটারটি দেখে আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়। তাই সত্যতা যাচাইয়ে খোঁজ-খবর নিই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এমপি সাহেব এই ডিও লেটার ইস্যু করেননি। তবে এক শ্রমিক লীগ নেতার মাধ্যমে ডিওটি কাউন্টারে আসায় আগেই টিকিট ইস্যু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পুরো বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে শ্রমিক লীগ নেতা আকতার আলীর ব্যবহৃত মুঠোফোনে মঙ্গলবার রাত থেকে আজ বুধবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অসংখ্যবার ফোন করা হয়। কিন্তু তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে এমপির ডিও লেটারটি কীভাবে তার হাতে আসলো তা জানা সম্ভব হয়নি।

তবে রেলওয়ের বিশ^স্ত একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শ্রমিক লীগ নেতা আখতার এর আগেও বিভিন্ন সময় পশ্চিম রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হাত করে এমপি, মন্ত্রী ও মেয়রের ডিও লেটার জালিয়াতি করে পশ্চিম রেলের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারির পদোন্নতি, বদলি এমনকি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রেলে অনেকের চাকরির তদবিরও করেছেন।’

জানতে চাইলে কেশরহাট পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান বলেন, ‘আমি এমপির বন্ধু, সেই সাথে আমি একজন জনপ্রতিনিধি। আর আমি এমপির ডিও দিয়ে টিকেট কেটে ঢাকায় যাবো, এটা কীভাবে সম্ভব? এমপির ডিও লেটার কে, কীভাবে জালিয়াতি করে টিকেট কেটেছে তা আমার বোধগম্য নয়। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে আমি পশ্চিম রেলের কর্তা ব্যক্তিদের অনুরোধ করছি।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘ডিও লেটারটা ছিল ভুয়া। আমরা এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছি। আশা করছি, কারা এই ডিও লেটারের সঙ্গে জড়িত তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ঘটনার সঙ্গে পশ্চিম রেলের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এমপি আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘ আমি ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য কোনো ডিও লেটার ইস্যু করিনি। এটা এক ধরনের প্রতারণা ও জালিয়াতি। যারা আমার ডিও লেটার জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তদন্ত কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশাবাদী।’

এএইচ/এস