এমটিএফই’র প্রতারণা

নজরদারিতে সিইওরা, তদন্তে ব্যবহার হচ্ছে এআই-রোবট


সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

কেউ বিক্রি করেছেন শখের মোটরসাইকেল, কেউ নিয়েছেন ব্যাংক থেকে ঋণ। কেউ আবার রেখেছেন জমি বন্ধক, নয়তো করেছেন ধারদেনা কিংবা গরু-ছাগল বিক্রি। সবাই হতে চেয়েছেন রাতারাতি ধনী। এই প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ ইনকরপোরেটেড (এমটিএফই)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন এমটিএফই-র সিইওরা। মামলাও হয়েছে কয়েকটি। তদন্তে সহায়তা নেওয়া হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটের।

মূলত এটা মোবাইলভিত্তিক অ্যাপস। এই অ্যাপস ডাউনলোড করে যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারতেন। অ্যাকাউন্ট খোলার পরেই মূলত লেনদেন শুরু হতো। গত ১৭ আগস্ট হঠাৎ এমটিএফই-র অ্যাপ বন্ধ হওয়ায় লাখ লাখ মানুষের বিনিয়োগ করা অর্থ উধাও হয়ে যায়। উল্টো বেড়েছে তাদের ঋণের বোঝা।

প্রথমদিকে এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ পাঁচ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছিলেন। এমটিএফইতে করা বিনিয়োগ হারিয়ে অনেকে ফতুর হলেও পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন না কেউ। কারণ ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তবে এর মধ্যে সাহস করে কেউ কেউ থানায় অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ অ্যাপের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। টাকা কীভাবে পাচার হলো এবং কারাইবা এর সঙ্গে জড়িত এসব খুঁজতে ব্যস্ত সময় পার করছে পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো।

পুলিশ বলছে, এমটিএফই অ্যাপে রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজন হতো মোবাইল নম্বর, বিকাশ অথবা নগদ নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর। ভার্চুয়ালি ক্রিপ্টো কারেন্সি ও ডলার কেনাবেচা করা হলেও লভ্যাংশ দেওয়া হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। মোবাইল নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে যারা অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে। এজন্য পুলিশের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) কাজে লাগানো হচ্ছে।

যেভাবে কাজ করবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে অনলাইনে হরহামেশাই যে কেউ অ্যাপ ডাউনলোড করে অনেক কিছু করছে। এমটিএফই অ্যাপে যারা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তাদের ফুটপ্রিন্ট রয়ে গেছে। অ্যাপে যারা মোবাইল নম্বর, মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়েছেন তাদের খুব সহজেই খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি থানায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ চলছে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সিআইডির ফরেনসিকও এমটিএফই অ্যাপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে।

প্রতারণার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে করা কয়েকটি মামলা বিশ্লেষণ করে এবং মানুষের কাছ থেকে আসা তথ্য থেকে এমনটিই ধারণা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)। এ কারণে এই সিইওদের খোঁজে মাঠে নেমেছে সিআইডি।

এমটিএফই নিয়ে ঢাকায় মামলা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি সিআইডি ফাঁদে পড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে বিবৃতি দেয়। এরপর ২৮ আগস্ট রাতে মারুফ রহমান ফাহিম নামে এক ভুক্তভোগী মামলা করেন। রাজধানীর খিলগাঁও থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে তিনি প্রধান আসামি করেন মাসুদ আল ইসলামকে। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের সাতপুরায়।

এজাহারে বলা হয়, মাসুদ নিজেকে এমটিএফইর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দাবি করেছিলেন। মামলায় দুই নম্বর আসামি দক্ষিণ খিলগাঁওয়ের মুবাশসিরুল ইবাদ। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ইবাদ হলেন মামলার বাদীর মায়ের বান্ধবীর স্বামী। তারা পূর্বপরিচিত ও একই এলাকায় বসবাস করেন। বাদী তাকে আঙ্কেল বলে ডাকেন। মাস ছয়েক আগে ইবাদের কাছ থেকে এমটিএফই সম্পর্কে জানতে পারেন বাদী। ইবাদ তাকে জানান, ওই অ্যাপে দিনে ২০১ ডলার বিনিয়োগ করলে ২৪ ঘণ্টায় ৫ ডলার লাভ দেওয়া হয়। এমন প্রলোভনে বাদীর মা রোকেয়া পারভীন রুনার নামে এমটিএফইতে হিসাব খোলেন বাদী। বাদীর বাবা ও ভাইয়ের নামেও হিসাব খোলা হয়। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা প্রায় ১০ লাখ টাকা হারিয়েছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন।

যেভাবে লাভ হতো এমটিএফই অ্যাপে

আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে ট্রেডিংয়ের সুযোগের নামে পরিচালিত হচ্ছিল পঞ্জি স্কিমের অ্যাপ এমটিএফই। ক্রিপ্টো কারেন্সিসহ বৈদেশিক স্টক পর্যন্ত ট্রেড করার সুযোগ ছিল এতে। ফলে অল্প সময়ে অ্যাপটি সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ট্রেডিং থেকে ধাপে ধাপে গ্রাহকের মুনাফা দেখানোর প্রলোভন দেখানো হয়। সহজপথে আয়ের লোভ দেখানোই ছিল এমটিএফই অ্যাপের মূল লক্ষ্য। প্রতিদিন ২৬ ডলার বিনিয়োগে দৈনিক ৮ ডলার আয়ের সুযোগ ছিল এতে। তবে শর্ত ছিল প্রতিদিন কমপক্ষে আধাঘণ্টা মোবাইল অ্যাপটি খোলা রাখতে হবে। অ্যাপটিতে ইনভাইট করে রেফারেন্স আইডি দিলে তিনি পেতেন দুই ডলারেরও বেশি।

এমটিএফইতে কীভাবে বিনিয়োগ করলেন বাংলাদেশিরা?

অ্যাকাউন্ট খুলে এমটিএফইয়ে প্রথমে বিনিয়োগ করতে হয়। তবে বাংলাদেশে বিদেশি সম্পদে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। তাহলে প্রশ্ন আসে এখানে কীভাবে বিনিয়োগ করলেন সাধারণ মানুষ। এমটিএফইয়ে প্রথমে গ্রে মার্কেট থেকে ক্রিপ্টো কারেন্সি কিনতে হয়। প্রথমে ডলারে কিনে পরে লাভসহ টাকায় রূপান্তর করতেন।

গুগল প্লে স্টোর ও অ্যাপল স্টোরে পাওয়া যায় এমটিএফই অ্যাপটি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এটি। গ্রাহকদের সিমুলেশন প্ল্যাটফর্মে ট্রেডিং চর্চা করতে বলে অ্যাপটি। ট্রেডিংয়ের এ চর্চার সময় লাভ-ক্ষতি যাই হোক, তার মালিকানা থাকে ব্যবহারকারীর কাছে। অ্যাপটিতে রেজিস্ট্রেশনের জন্য নিজের মোবাইল নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর জমা দিতে হয় গ্রাহকদের। এসব ডকুমেন্ট দেওয়ার পরই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হতো। ভার্চুয়ালি ক্রিপ্টো কারেন্সি ও ডলার কেনাবেচা করা হলেও লভ্যাংশ দেওয়া হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

এমটিএফই জালিয়াতি ঠেকাতে গঠন হচ্ছে টাস্কফোর্স

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এমটিএফইর মতো প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ঠেকাতে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের ওপর জোর দিতে বলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। অনলাইনের মাধ্যমে অবৈধ আর্থিক লেনদেন ও প্রতারণা থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংককে লিড এজেন্সি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএসএ এবং বিটিআরসিকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তিনি।

যা বলছেন তদন্ত কর্মকর্তারা

ডিএমপি, বগুড়া, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়ায় করা কয়েকটি মামলা বিশ্লেষণ করে সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, দেড় থেকে দুই কোটি টাকা যারা বিনিয়োগ করিয়েছিলেন, এমন ব্যক্তিদের সিইও ঘোষণা করেছিল এমটিএফই। বিনিয়োগকারীদের টাকার ওপর মোটা অঙ্কের কমিশনও ছিল তাদের জন্য। এই সিইওদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও আছেন। তাদের অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে নজরদারিতে থাকা কয়েকজনের দাবি, তারা নিজেরাও লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দুবাইভিত্তিক এমটিএফইর প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক কুমিল্লার মাসুদ আল ইসলাম। তিনিও দুবাইয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন। পরে নিজেই দেশে ব্যবসা করতে এ অ্যাপ চালু করেন। মাসুদকে দেশে ফেরানো না গেলে এমটিএফইতে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত আনা সম্ভব নয়। তাই ইন্টারপোলের সহায়তায় তাকে ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে। অবশ্য টাকা পাচার করে বিদেশে চলে যাওয়া কোনো অভিযুক্তকেই এখনো ফেরাতে পারেনি পুলিশ।

এ বিষয়ে কথা হয় সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহার সঙ্গে। তিনি বলেন, এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিন্যান্স নামে যে অ্যাপস ছিল সেটিতে অফিসিয়ালি সবকিছু রয়েছে। সেখানে কারা জড়িত এবং কারা কত টাকা ইনভেস্ট করেছে তাও রয়েছে। বিন্যান্স অ্যাপসের কোনো তথ্য জানতে হলে তাদের কাছে সহায়তা চাইতে হবে। অ্যাপসের তথ্যগুলো নিতে হলে মামলা রুজু করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে এই তথ্য চাওয়া যেতে পারে এবং কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।

সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ বলেন, এমটিএফই নিয়ে ভুক্তভোগীরা প্রথমে মামলা না করতে চাইলেও এখন দেশের কোনো না কোনো থানায় মামলা হচ্ছে। সিআইডি মামলার তদন্ত শুরু করেছে। অ্যাপে যারা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এবং লেনদেন করেছেন তাদের ফুটপ্রিন্ট অনলাইনে রয়েছে। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও রোবট ব্যবহার করেও কাজ চলমান।