এপ্রিলে টিকিট বিক্রি বেড়েছে ১৪৩ কোটি টাকা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে নেমে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া ক্র্যাকডাউনে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করে দুর্নীতি সিন্ডিকেটের পুরো নেটওয়ার্ক। এর ফলে টিকিট দুর্নীতি একরকম শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। শুধু এপ্রিল মাসেই টিকিট বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা, যা বিমানের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে প্রমাণিত হয়েছে, এই খাতেই প্রতি মাসে বিমানে কী পরিমাণ দুর্নীতি ভর করেছিল। সরকারের আর্থিক ক্ষতির হিসাব কষলে সে পরিমাণও নিশ্চয় বিস্মিত হওয়ার মতো।

প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে টিকিট বিক্রি খাতে বিমানের আয় হয় ২৭০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেখানে এ বছর এপ্রিল মাসে আয় হয়েছে ৪১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৪২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রশ্ন হল, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে টিকিট বিক্রির টাকার অংকের এমন বড় পার্থক্য কেন। জবাবটাও সোজাসাপ্টা।

গত বছর ডিসেম্বর থেকে বিমানের টিকিট দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করে। এর ফলে এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে বিমানের টিকিট বিক্রির হার গত বছরের তুলনায় বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুরো দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে ২৪ মার্চ থেকে বড় ধরনের সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে মন্ত্রণালয়। যার ফলে রাতারাতি ধরা দেয় সাফল্যের এমন রেকর্ড।

টিকিট বিক্রির তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে ২৮৩ কোটি ৩৬ লাখ। এ বছর যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪৭ কোটি ৩৫ লাখ। ১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে টিকিট বিক্রি হয় ২২৩ কোটি ৩২ লাখ। বিপরীতে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ২৯৯ কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া গত বছর মার্চে বিমানের টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয় ২৫৪ কোটি ১৭ লাখ, যা এ বছর মার্চে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪৫ কোটি ৪৮ লাখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতিবিরোধী জোরদার মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর করার আগে বিমানের টিকিট দুর্নীতি সিন্ডিকেটের সদস্যরা টিকিট ব্লক করে বেশি দামে কালোবাজারে বিক্রি করত। তাদের সুবিধামতো টিকিট বিক্রি না হলে ব্লক করা টিকিট বিক্রি না করে খালি সিট নিয়ে বিমান ছাড়া হতো। এ ছাড়া বিমানের টিকিট বিক্রির নিয়ম হল ফ্লাইটের দিন যত ঘনিয়ে আসবে তত টিকিটের দাম বাড়বে। কিন্তু বিমানের টিকিট বিক্রি দেখানো হয়েছে কমন রেটে। এতে করে বছরের পর বছর ধরে সরকারকে বিপুল অংকের লোকসান গুনতে হয়েছে। এভাবে দুর্নীতিবাজ চক্র শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। তদন্ত হলে দেখা যাবে, দেশে ও বিদেশে নামে বেনামে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ। বিভিন্ন সংস্থার প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন আভাস মিলছে।

বিমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানামুখী অ্যাকশন প্ল্যানে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের কয়েকজন সোমবার বলেন, এই সাফল্যের জন্য প্রথমত আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান দৃঢ় হওয়ায় দীর্ঘদিনের দুর্নীতির শক্ত জাল মন্ত্রণালয় সাহসের সঙ্গে ভেদ করতে পেরেছে।

দ্বিতীয় কৃতিত্ব মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী এবং সচিব মহিবুল হকের। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সততা ও সাহসের সঙ্গে অবিচল থেকে ক্রমেই মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করায় দুর্নীতিবাজ চক্র হালে পানি পায়নি। একপর্যায়ে তারা সচিবকে বদলি করার অপচেষ্টা নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু শেষমেশ সেটিও ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো অনেকের বিদেশে সটকে পড়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

সূত্র বলছে, বিমান দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গডফাদারদের বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের বিষয়ে ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ শুরু করেছে। যাদের কয়েকজনের সব মুভমেন্ট গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে। দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি ধাপে মন্ত্রণালয় থেকে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট নেয়া হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলেন, সিবিএ নেতাদের বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যে নিশ্চিত হয়েছে যে, তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড কখনও সরকারবান্ধব ছিল না। তারা আওয়ামী লীগের লেবাস ব্যবহার করে শুধু নিজেদের পকেট ভারি করেছে। বিপরীতে বিমানকে দুর্নীতির অতল গহ্বরে ডুবাতে সক্রিয় ছিল। তাই তাদের কাউকে সরকার ক্ষমা করবে না।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ মার্চ বিমান বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স লিমিটেডের টিকিট বিক্রি ব্যবস্থাপনার নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় কার্যবিবরণীতে বিস্তর তথ্য তুলে ধরা হয়। বৈঠকে দুর্নীতির ১০টি ধাপ উল্লেখ করে বিমান সচিব সভায় বলেন, বিমানের রিজার্ভেশন বা টিকিট বিক্রি কার্যক্রম সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে সামান্য কিছু টিকিট অনলাইনে সচল রেখে বাকি টিকিট ব্লক করে রাখা হয়।

অথচ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা দিলে টিকিট পাওয়া যায়। এভাবে টিকিট বিক্রি প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। অনেক সময় অনেক সিট খালি রেখে বিমান যাত্রা করে। দীর্ঘদিনের এমন অভিযোগ সামনে নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও মন্ত্রণালয় ব্যাপক অনুসন্ধানে নামে। এর ভিত্তিতে টিকিট দুর্নীতির বহু প্রমাণিত তথ্য বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন বিমানের বিভিন্ন ফ্লাইটে প্রায় আট হাজার টিকিট থাকে। এর মধ্যে চক্রটি টার্গেট অনুযায়ী সর্বনিম্ন দামের কয়েকশ’ টিকিট ব্লক করে রাখে। যেগুলো বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে বেশি মূল্যে বিক্রি করে। এভাবে তারা প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পকেটস্থ করে।

বিমানের টিকিট বুকিং দেয়ার জন্য গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তাও বিমানের স্বার্থবিরোধী। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ৩০০ আসনের একটি ফ্লাইটে ২ থেকে ৩ হাজার বুকিংও হয় অনেক সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যার অধিকাংশ বুকিং বাতিল হয়েছে। অগত্যা বিমানকে খালি আসন নিয়ে উড্ডয়ন করতে হয়। বাস্তবতা হল, টিকিট দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত চক্রটি বেশির ভাগ টিকিট কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রির আসায় আগাম বুকিং করে রাখে।

এভাবে তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ পন্থায় পকেট ভারি করার কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু এর ফলে শেষদিকে যেসব টিকিট আর বিক্রি হয় না ওই আসনগুলো খালি নিয়ে ফ্লাইট ছাড়তে হয়। এতে করে যা লোকসান হওয়ার তা বিমানেরই হয়। অপর দিকে প্রতিটি বুকিং বাতিলের জন্য জিডিএস কোম্পানিকে একটা মাশুল দিতে হয় বিমানকে।

গত মাসে জিডিএস কোম্পানির বিল ছিল ১৪ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা)। এ বিল ২২ লাখ ডলারও হয়েছে কোনো কোনো মাসে। অভিযোগ আছে, শুধু জিডিএসের বিল বাড়াতে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি প্রচুর টিকিট বুকিং দেয়, আবার বাতিলও করে দেয়। যার বিনিময়ে ওইসব এজেন্সি জিডিএস কোম্পানি থেকে কমিশন পায়।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এসেছে, জিডিএস কোম্পানিকে যাচাই ও প্রত্যয়ন ছাড়াই টিকিট বিক্রি, বুকিং ও বাতিল ফি দেয়ায় বছরে প্রায় শত কোটি টাকার অনিয়ম হচ্ছে বিমানে।

সূত্র আরও জানায়, বিমানের টিকিট ব্লক করে কালোবাজারে বিক্রির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এর মাধ্যমে আশরাফুল আলম ও শফিকুল ইসলামের সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে। বিদেশে টাকা পাচার করেছে। বিমান মন্ত্রণালয় অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছে চক্রটি এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এসব অনিয়মের অভিযোগে গত মাসের শেষ দিকে বিমানের পরিচালনা পর্যদ সভায় বিমান এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। নতুন এমডি নিয়োগ না দেয়া পর্যন্ত পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।