একাকী মা-বাবার বিয়ে মানতে কতটুকু রাজি ছেলে-মেয়ে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

স্বামী বা স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পরিবার, সন্তান কিংবা সমাজের কথা চিন্তা করে অনেক নারী বা পুরুষই দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান না। বিশেষ করে নারীদের অনেক ক্ষেত্রেই একাকীত্ব নিয়েই দীর্ঘ জীবন কাটাতে হয়। যদিও দেশের পুরুষদের মধ্যে অনেকে একাধিক বিয়ে করে থাকেন।

আবার কোন কোনো ক্ষেত্রেই মায়ের মৃত্যু আগে হলে সন্তানরাই বাবার পুনরায় বিয়ে করাকে মেনে নেন না আর বাবার মৃত্যু আগে হলে মায়ের বিয়ের বিষয়টি সাধারণত সন্তানরা বিবেচনাতেই নেন না।

তবে সাম্প্রতিককালে দু একটি ক্ষেত্রে সন্তানরা তাদের একা হয়ে পড়া মায়ের বিয়ের উদ্যোগ নিয়ে যেমন প্রশংসিত হয়েছেন আবার সমালোচনাও এসেছে আত্মীয় স্বজনের দিক থেকেই। সামাজিক মাধ্যমেও প্রশংসার পাশাপাশি আক্রমণাত্মক অনেক মন্তব্যও এসেছে।

সম্প্রতি জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা নামের একজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাদের মায়ের বিয়ের খবর দিয়েছিলেন।

তিনি লিখেছিলেন, “আজ আমাদের মায়ের বিয়ে। আমরা ২ বোন, আমার হাজবেন্ড এবং পরিবারের কয়েকজন সদস্য মিলে হাসিমুখে আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি। কিছুদিন আগে আমার বিয়ের ১ বছর পূর্ণ হলো। আমার মা একা হাতে যতটুকু সম্ভব ছিল ততটুকু করেই আমাকে নতুন সংসারে পাঠিয়ে নিজে সম্পূর্ণ একা হয়ে পরেছিলেন কারণ তার স্বামীও নেই, ছেলেও নেই, বড় ভাই নেই, এবং বাবাও নেই। মোটকথা, তাকে নিরাপত্তা দেয়ার অথবা একান্তে কিছু কষ্ট ভাগ করে নেয়ার তেমন কোনো মানুষ ছিল না। তাই আজ আমরা আমার মাকে নতুন একটা সংসার দিলাম”।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন যে তাদের পরিচিতদের অনেকেই এটি গ্রহণ করতে পারেননি। অথচ তার মা যখন একা ছিলেন তখন অনেকেই ফোন করে বিরক্ত করেছে বা বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে।

“এখন আমরা যখন নিজেরাই উদ্যোগ নিলাম তখন কেউ কেউ বলছেন আমরা দায়িত্ব নিতে চাইনি বলে এটি করেছি বা এ ধরণের আরও নেতিবাচক কথাবার্তা। আসলে আমাদের সমাজটাই এখনো সন্তানরা বাবা বা মায়ের পার্টনার খুঁজে দিচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে এটি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয়নি,” বলছিলেন তিনি।

কেন মায়ের দিয়ে দিলেন

এই প্রশ্নের জবাব জান্নাতুল ফেরদৌস তার ফেসবুক পোস্টেই দিয়েছিলেন।

সেখানে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা শুনতে খুবই খারাপ শোনায় তাই না? বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে বিয়ে এটা কি ধরনের কথা, মহিলাটা মনে হয় ভালো না, স্বামীকে মনে হয় ভালোবাসতো না তাই বিয়ে করলো ইত্যাদি ইত্যাদি! তাই আমাদের মনে হয়েছে একা থেকে লোকের আজেবাজে কথা শুনে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বিয়ের মত পবিত্র ব্যাপার আর কিছু হতেই পারে না”।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন যে, তাদের মা যেন একাকীত্বের কষ্টে না পড়েন কিংবা একা থাকার কারণে কোনো বিপদে না পড়েন সেজন্যই তারা পারিবারিকভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছেন।

এর আগে কেরানীগঞ্জের এক তরুণ তার মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিলেন গত জুলাই মাসে।

ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন – “বাবা মারা গেছেন তাই আম্মুর জন্য পাত্র খুঁজছি”।

‘বিসিসিবি মেট্রিমনিয়াল: হেভেনলি ম্যাচ’ নামের ফেসবুক গ্রুপে মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন ওই তরুণ।

মূলত দু বছর আগে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। আবার তার বড় ভাইয়ের সংসার আছে। নিজেও ভবিষ্যতে বিয়ে করবেন। এসব চিন্তা থেকে ৪২ বছর বয়সী মাকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন তিনি, যাতে কারে তার মাকে একাকীত্ব নিয়েই বাকী জীবন কাটাতে না হয়।

বিধবা মা কিংবা বিপত্নীক বাবার বিয়ে কতটা সহজ

বাংলাদেশে অনেক পুরুষ একাধিক বিয়ে করলেও অনেক পরিবারেই স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তান, পরিবার ও সমাজের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা করতে পারেন না অনেক পুরুষ।

কারণ স্ত্রী মারা গেলে অনেক ক্ষেত্রে সন্তানরাই বাবার দ্বিতীয় বিয়েকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে। অনেক সময় ছেলে বা মেয়েরা তাদের শ্বশুরবাড়িতে হেয় হবেন বলে নিজের বাবা বা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের বিরোধিতা করেন।

আবার বাবা বা মায়ের নামে থাকা সম্পদও অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে সমাজেও বয়স্ক ব্যক্তিদের পারিবারিক আয়োজনে দ্বিতীয় বিয়ের ধারণাটি খুব একটা প্রচলিত নয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সমালোচনা হয় অনেক বেশি।

বিধবা নারীর আবার স্বামী লাগবে কেন কিংবা এখন তার স্বামীর দরকার কি -এমন সব আপত্তিকর প্রশ্নও ছুড়ে দেয়া হয় নারীর দিকে। তেমনি পুরুষের ক্ষেত্রেও -পুরো ব্যাটার আবার বউ লাগবে কেন- এমন প্রশ্ন শোনা যায় হরহামেশাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলছেন, মানুষ বয়স্ক হবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু কেউ একা হয়ে গেলে তার পার্টনার পাওয়ার অধিকার আছে।

“কিন্তু আমাদের সমাজে নারীদের জন্য এই সুযোগ নেই বললেই চলে। স্বামী নেই, ছেড়ে গেছেন বা মারা গেছেন। আবার ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলেও বাবা মা একা হয়ে যান। কিন্তু এভাবে জীবন কাটানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে”।

তিনি বলছেন যে এখন মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। এ কারণেই অনেককে একাই দীর্ঘ জীবন কাটাতে হচ্ছে। আবার একজন নারীকে একা জীবন চালানো সহজ হয় না সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও।

সেকারণেই একা হয়ে পড়া পুরুষ বা নারী একজন পার্টনার বিয়ের মাধ্যমে নেয়াটাই স্বাভাবিক ও বাস্তবিক বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

সম্প্রতি অবসরে গেছেন মুশফিকুল ইসলাম। স্ত্রীকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই বেড়াতে বের হন তিনি।

মিস্টার ইসলাম বলছেন যে , “এই বয়সে সঙ্গী না থাকা কতটা সমস্যার সেটা এই বয়সে না এলে বোঝা যায় না। পারস্পারিক দেখভাল করা ছাড়াও সময় কাটানো কিংবা কথা বলার জন্যও একজন পার্টনার জরুরি। তবে ছেলেমেয়েরা এটি বুঝতে পারলে তাদের বাবা হারানো মা কিংবা মা হারানো বাবার জীবন কিছুটা হলেও সহজ হয়”।

কিন্তু সেজন্য বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা কবে প্রস্তুত হবে সেটি অবশ্য কারও জানা নেই। সূত্র বিবিসি বাংলা