একটিমাত্র কিশোরীর রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে এক ঔষধ আবিষ্কার করলেন আমেরিকার বিজ্ঞানীরা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

মস্তিষ্কের একটি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত আট বছরের মেয়েটিকে এমন একটি ওষুধ দেয়া হয়েছে, যেটি শুধুমাত্র তার জন্যেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন।

মিলা মাকোভেকের বয়স এখন আট বছর যার ‘ব্যাটেন ডিজিজ’ নামের মস্তিষ্কের একটি ভয়াবহ এবং দুরারোগ্য রোগ হয়েছে।

তার চিকিৎসায় এক বছরের কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন চিলড্রেন হসপিটালের চিকিৎসকরা একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যা বিশেষভাবে শুধুমাত্র মিলা’র ডিএনএ ক্রুটি সারাতে সহায়তা করবে।

এর ফলে তার মূর্ছা যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে গেছে, যদিও তাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়।

ব্যাটেন ডিজিজ:

এর ফলে ক্রমে মস্তিষ্কের নিউরনে ক্ষয় হতে থাকে, স্নায়ুর সমস্যা তৈরি হয় এবং চোখের রেটিনা আক্রান্ত হয়।

এটি একটি বিরল রোগ। কিন্তু এতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমস্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে এবং এবং সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয় না।

মিলার বয়স যখন তিন বছর, তখন থেকে তার ডান পা ভেতরের দিকে ঘুরে যেতে শুরু করে। এক বছর পরে তার দৃষ্টিশক্তি এতোটাই কমে যায় যে, কোন বই পড়তে হলে তাকে মুখের কাছে ধরতে হতো। পাঁচ বছর বয়সের সময় সে প্রায়ই পড়ে যেতো এবং তার হাঁটাচলা হয়ে যেতো অসংলগ্ন।

ছয় বছর বয়সে মিলা অন্ধ হয়ে যায়, খুব কম কথা বলতে পারতো আর প্রায়ই মূর্ছা যেতো।

জিনগত বড় ধরণের পরিবর্তনের কারণে এই রোগটি তৈরি হতে পারে। যার ফলে কোষের ভাঙ্গন বন্ধ এবং বর্জ্য পরিশোধন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

তার পরিবর্তে, শরীরের ভেতরের আবর্জনার জন্ম হতে থাকে, যার ফলে শেষপর্যন্ত মস্তিষ্কের কোষগুলোর মৃত্যু হতে পারে।

চিকিৎসার যাত্রাপথ

মিলার পরিবারের সদস্যদের ব্যাটেন রোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তাদের জিনে এই রোগটি রয়েছে। তখন তারা ‘মিলা’স মিরাকল ফাউন্ডেশন’ নামের একটি অভিযান শুরু করেন এই আশা নিয়ে যে, তারা মিলাকে আরোগ্য করে তুলতে পারবেন।

ড. টিমোথি ইয়ু বলছেন, ”এক রাতে যখন আমি খাবার টেবিলে বসেছিলাম, আমার স্ত্রী জানালেন যে, তার একজন বন্ধু ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন, যেখানে কলোরাডোর একটি পরিবার সাহায্য কামনা করছে।”

 

শুধুমাত্র মিলার জন্য বিশেষ একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা
শুধুমাত্র মিলার জন্য বিশেষ একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা

মিলার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এবং এরপরে তাদের বেশ দ্রুত সাক্ষাত হয়।

তাদের চিকিৎসক দলটি মিলার ডিএনএ-র জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন মাণচিত্র) তৈরি করে, তার জেনেটিক কোড বের করে এবং দেখতে পায় যে, জিনের একটি অভিনব পরিবর্তন হয়ছে।

ক্রুটি সনাক্ত করতে পারায় গবেষকরা চিন্তা করতে শুরু করলেন যে, রোগটির একটা চিকিৎসা পদ্ধতি তারা খুঁজে বের করতে পারবেন।

তারা একটি ওষুধের নকশা করার পরে গবেষণাগারে মিলার কোষ এবং পশুর ওপর সেটির পরীক্ষা করলেন। সফলতা পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন থেকে স্বীকৃতিও পাওয়া গেলো।

এরপরে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ‘মিলাসেন’ নামের ওই ওষুধ দিয়ে মিলার চিকিৎসা শুরু করা হয়।

সাধারণত কোন ওষুধের আবিষ্কার, ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রোগীদের হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় ১৫ বছর লেগে যায়।

সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের এই চিকিৎসক দলটি মাত্র এক বছরে ওষুধটি আবিষ্কার করে প্রয়োগ করেছে।

”যখন আমরা কাজটি শেষ করে পেছনের দিকে তাকালাম, আমরা খুব গর্ববোধ করলাম আর অবাক হলাম। মাঝে মাঝে অবুঝের মতো হওয়াটা ভালো, বিশেষ করে আমরা যখন জানি একটি শিশুর আয়ু কমে যাচ্ছে। তখন টিমের সবাই অসাধারণ দ্রুত গতিতে কাজ করার তাগিদ বোধ করেছে”, বলছিলেন ড. ইয়ু।

তিনি আরো বলছেন, ”আমাদের জানা মতে এমন আর কোন ঘটনা নেই, যেখানে কোন ওষুধ এইভাবে তৈরি করা হয়েছে।”

মিলার জন্য এটা কতটা উপকারী হয়েছে?

এর মধ্যেই যে ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা আর কাটিয়ে উঠতে পারবে না এই ওষুধ।

ড. ইয়ু  বলেছেন, ”প্রথম বছরটা আমরা সত্যিই খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল, রোগটির খুব আস্তে আস্তে বিস্তার হচ্ছে।”

এটা এমন একটা রোগ যার অবনতির ব্যাপারটি অনিবার্য।

এর আগে মিলা দিনে ১৫ থেকে ৩০ বার অচেতন হয়ে যেতো (সাধারণত এই সময় দুই মিনিট স্থায়ী হয়)।

কিন্তু ওষুধটি শুরু করার পর সেটি দিনে ০ থেকে ২০ বারে নেমে আসে, যা সাধারণত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়।

তার পরিবার জানিয়েছে, সে এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে এবং আগের চেয়ে ভালো থাকছে।

তবে দ্বিতীয় বছরের চিকিৎসায় লক্ষ্মণ দেখা দিতে শুরু করে যে, রোগটির আবার বিস্তার ঘটছে এবং মিলাকে ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা শুরু হয়।

ড. ইয়ু বলছেন, ”আমরা ভাবছিলাম, এটা যতটা হওয়ার কথা তার চেয়ে কম বাড়ছে এবং আশা করছিলাম যে, সেটা আবার স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।”

তিনি বিশ্বাস করেন, এ ধরণের রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে যদি আরো আগে হস্তক্ষেপ করা যায়, বিশেষ করে যখন কোন শিশুর বয়স তিন থেকে চার বছর, তাহলে ‘সত্যিই বড় সফলতা পাওয়া যেতে পারে’।

ইঞ্জেকশন
     আবিষ্কৃত ওষুধটি মিলার স্পাইনাল কর্ডে দিতে হয়

ওষুধটি যেভাবে কাজ করে?

পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ অভিনব একটা ব্যাপার, যেখানে আগে বোঝা দরকার হয় যে, কোথায় সমস্যার তৈরি হয়েছে।

মিলার ডিএনএ-র মধ্যে প্রোটিন তৈরির একটি জিনগত বৈশিষ্ট্যে ক্রুটি ছিল এবং এর ফলে তৈরি হওয়া অকার্যকর প্রোটিনের ফলে তার ব্যাটেন রোগটি হয়েছে।

ডিএনএ থেকে প্রোটিনের মাঝে একটি পর্যায় রয়েছে- এমআরএন নামের একটি বার্তাবাহক তৈরি হয় যেটি ডিএনএ-র নির্দেশনাটি কোষের নিউক্লিয়াসে নিয়ে যায়, যেখানে প্রোটিন তৈরি হয়।

কিন্তু এই বার্তাবাহকটি তৈরিতে একটি সমস্যা ছিল।

ডিএনএ-র একটি অংশের সবগুলো জেনেটিক কোড এমআরএনএতে পরিবর্তিত হচ্ছিল না-কিছু অংশ এই প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছিল, যাকে বলা হয় স্পেলিসিং।

কিন্তু মিলার ক্ষেত্রে স্পেলিসিং ব্যাপারটি ঠিক মতো হচ্ছিল না। সুতরাং কোষের ভেতর ভুল বার্তা তৈরি হচ্ছিল, ফলে একটি ক্রুটি যুক্ত প্রোটিনের জন্ম হচ্ছিল।

তখন চিকিৎসকদের দলটি এমন একটি ওষুধ তৈরি করে যা এমআরএনএ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে এবং সেটির ভুল পথে যাওয়া ঠেকাবে।

এটা হচ্ছে সেই ধরণের প্রযুক্তি, যাকে বলা হয় অ্যান্টিসেন্স অলিগোনুক্লিয়োটাইড থেরাপি- যা হান্টিংটন নামের একটি রোগের চিকিৎসায় প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে এই গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে।

খরচ কতো?

ব্যক্তিগত চিকিৎসায় আবিষ্কৃত এই ওষুধের উচ্চমূল্যের ফলে এটি সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।

গবেষণা দলটি জানায়নি যে, তারা এই ওষুধ আবিষ্কারের পেছনে কতো অর্থ ব্যয় করেছে।

কিন্তু ড. ইয়ু বলেছেন, ”আমরা এটি নিয়ে সামনে এগোতাম না, যদি আমরা এটাকে সবার পাওয়ার একটি পথ দেখতে না পেতাম।”

”ওষুধটির মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই ধারণাটি আমরা শুধুমাত্র কোটিপতিদের জন্য বানাইনি।”

ওষুধের ক্ষেত্রে এটি কী নতুন ধ্যানধারণা?

সেটা বলা যায়।

জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে সাত হাজারের বেশি বিরল রোগ রয়েছে, যার অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার কোন পদ্ধতি চালু নেই।

সব বিরল রোগ নয়-এমনটি ব্যাটেন রোগের ক্ষেত্রেও মিলার মতোএকই ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়তো সম্ভব হবে না।

কিন্তু ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ তৈরির আশা তৈরি হয়েছে, যা তৈরি হবে জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে, রোগটি কী কারণে তৈরি হচ্ছে আর তার জন্য ঠিক কী ধরণের চিকিৎসা প্রয়োজন হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তা ড. জ্যানেট উডকক বলছেন, ব্যক্তিনির্ভর এসব ওষুধ, যাকে বলা হয় এন-অফ-ওয়ান, একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়, যা নতুন আলোচনা তৈরি করেছে।

তিনি বলছেন, ”এ ধরণের পরিস্থিতিতে একজন মানুষের ক্ষেত্রে নতুন ধরণের ওষুধ ব্যবহার করতে হলে কোন ধরণের প্রমাণ প্রয়োজন?”

”এমনকি দ্রুত বিস্তার ঘটছে এমন রোগের ক্ষেত্রেও, মারাত্মক অসুস্থতায়, গুরুতর জটিল রোগেও মৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ন্যূনতম নিশ্চয়তা কী?”