এই মরণব্যাধি কি মানবতার বিলোপ ঘটাবে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

কী লিখব তাই ভাবছি। দিগ্বিজয়ী করোনাভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে আছি। ছাত্র থাকাকালে পাঠ্যপুস্তকে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের কাহিনী পড়েছি। চেঙ্গিস খাঁর মস্কো অভিযানের কাহিনী পড়েছি।

যে অভিযানে মস্কোর ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছিল- ‘ভগবানের মা (মা মেরি) আমাদের রক্ষা করো।’ নাদির খাঁর দিল্লি অভিযানের কথা জেনেছি। আতঙ্কে সারা শহরের লোক পালিয়েছিল। তারপর এ যুগে দেখেছি হিটলারের বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধ নামে হলেও তা ছিল মূলত ইউরোপে সীমাবদ্ধ।

কিন্তু এবারের করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর অভিযান সত্যি সত্যিই বিশ্ব অভিযান। বিশ্বের ৮৫টির বেশি দেশে এ রোগ ছড়িয়েছে।

মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ত্রিশ হাজার ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ ভাইরাস যদি হিটলার-মুসোলিনির মতো মানুষ হতো, তাহলে আতঙ্কিত বিশ্বের মানুষ হয়তো তার বন্দনায় মুখর হয়ে উঠত।

এ ভাইরাসের বিশ্ব অভিযানের বৈশিষ্ট্য, সে শত্রু-মিত্র কাউকে রেহাই দেয় না। চীন এবং ইরান আমেরিকার প্রায় শত্রুদেশ। এই দুই দেশ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে।

তাতে ট্রাম্প সাহেবের খুশি হওয়ার কথা। না, ট্রাম্প সাহেবের দেশেও এই ভাইরাস হামলা চালিয়েছে। ট্রাম্প সাহেব তার শত্রুদের যেমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তেমনি প্রথমে করোনাভাইরাসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ রোগ এমন কিছু নয়, চলে যাবে।’

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে।’ অর্থাৎ বাজ মাথায় না পড়া পর্যন্ত লোকে বলে এটা মেঘের ডাক। ট্রাম্প সাহেবেরও দেশে কোভিড-১৯ হামলা না চালানো পর্যন্ত এটাকে তিনি সামান্য রোগ বলে বিবেচনা করেছিলেন।

এখন কোভিড-১৯ মার্কিন মুল্লুকেও ছোবল মারার পর তার বোধোদয় হয়েছে। এ হামলার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য তিনি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছেন। তাতেও এ ভাইরাসের হামলা থেকে শিগগির বাঁচা যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

কথায় বলে, পরের জন্য কূপ খুঁদলে নিজেকে তাতে প্রথম পড়তে হয়। আমেরিকা বহুদিন থেকে তাদের গোপন গবেষণাগারে জীবাণু যুদ্ধের বিষাক্ত অস্ত্র তৈরির গবেষণা চালাচ্ছে ও এসব অস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এবং আফগান ও ইরাক যুদ্ধেও।

আমেরিকার বৈরী এবং নতুন সুপার পাওয়ার হিসেবে গড়ে উঠতে যাওয়া চীনও তার গোপন গবেষণাগারে এ অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে উহান প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার, সেখানেই এ গোপন গবেষণাগার রয়েছে বলে গুজব।

আমেরিকা ও চীন সম্পর্কে এ অভিযোগ সত্য হলে বলতে হয় অন্যের জন্য কূপ খননের প্রবাদটি সঠিক বলে প্রমাণিত।

চীন যদি আমেরিকার ওপর টেক্কা মারার জন্য জীবাণু-অস্ত্র তৈরি করতে গিয়ে পরীক্ষার ভুলে এ ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে, তাহলে এ ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তারই সর্বাধিক। চীন দ্রুত অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারে পরিণত হতে যাচ্ছিল, তাতে প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে।

আর ট্রাম্প সাহেবরা যদি এ কাজটি করে থাকেন, তাহলে এ ভাইরাসের ছোবল থেকে যে আমেরিকারও নিস্তার নেই এ সত্যটি এবার আরও ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে বিজ্ঞানীরা বিজাণু এবং জীবাণু দুই বিষাক্ত অস্ত্র তৈরি এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন জানা যায়, হিটলারকে আমরা যতই বর্বর ডিক্টেটর আখ্যা দেই, তার মধ্যেও যে মানবতাবোধ সময় সময় প্রকাশ পেয়েছে, তা ট্রুম্যান থেকে ট্রাম্প পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে দেখা যায়নি।

সম্প্রতি নতুনভাবে তাকে নিয়ে গবেষণা করে তার যে জীবনীগ্রন্থটি বেরিয়েছে (সানডে টাইমস কর্তৃক প্রশংসিত) তাতে দেখা যায়, হিটলার গান ভালোবাসতেন। বেভারিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে চমৎকার ছবি এঁকেছেন। প্রেমিকা ইভা ব্রাউনের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন।

যুদ্ধের শেষদিকে হিটলারের বিজ্ঞানীরা ভি-রকেট ছাড়াও ছোটখাটো আণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ছাড়া জীবাণু অস্ত্রও। কিন্তু তিনি এগুলো ব্যবহার করতে চাননি।

তার শিল্প ও ভাস্কর্যপ্রীতি এতই ছিল যে, তার সৈন্যরা প্যারিস দখলের পর যাতে এ শহরের প্রাচীন শিল্পকলা, ভাস্কর্য, ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস না করে সে জন্য নিজে সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্যারিসে আসেন এবং সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি নেপোলিয়নের সমাধিতে গিয়ে কিছুক্ষণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আমি ফ্যাসিস্ট হিটলারের প্রশংসা করছি না; শুধু বলছি, হিটলারের মতো অমানুষের মধ্যেও যে মানবিক গুণ ছিল তা আজকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের থ্যাচার, টনি ব্লেয়ারের মতো প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে ছিল না।

হিটলার তার বোমারুবিমানের পাইলটদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামসহ লন্ডনের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

আর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি ইরানের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেবেন। বাগদাদে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের রকেট হামলার পর তিনি সম্ভবত এ হুমকি কার্যকরে আর সাহস পাননি। তিনি যুদ্ধ বাধানোর হুমকি থেকেই পিছিয়ে যান।

বিজ্ঞানীরা বহু আগেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো যদি শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য ট্র্যাডিশনাল অস্ত্র ব্যবহারের ওপর নির্ভর না করে জীবাণু অস্ত্র ব্যবহারের জন্য তা তৈরি করা শুরু করেন, তাহলে এ গবেষণাগারের সামান্য ভুলত্রুটি বা দুর্ঘটনা থেকে যে ভাইরাস তৈরি হবে এবং ছড়াবে তা নানা মরণব্যাধির জন্ম দিয়ে গোটা মানবসভ্যতা ধ্বংস করার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বিজ্ঞানীদের এ সতর্কবাণী যে কতটা সঠিক, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল আণবিক গবেষণাগারে দুর্ঘটনার সময়।

এ দুর্ঘটনায় যে আণবিক তেজস্ক্রিয় ঘটে এবং ছড়িয়ে পড়ে, তা শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ক্যান্সার, লিউকেমিয়াসহ নানা দুরারোগ্য রোগের বিস্তার ঘটেছিল।

বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তা বিশ্বের বহু দেশের পানিতে, বাতাসে, ফলমূল, সবজিতে পর্যন্ত তার বিষ ছড়িয়েছে এবং মানুষের শরীরে তাদের অজ্ঞাতসারে ঢুকে নানা ভয়াবহ ব্যাধিতে ভোগাচ্ছে।

বর্তমানেও বহু বিজ্ঞানী আশঙ্কা করেন, করোনাভাইরাসও প্লেগ, কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্তের মতো কোনো প্রাকৃতিক বা জীবজন্তুবাহিত রোগ নয়, এটা মানুষের সৃষ্ট রোগ।

মানুষের জন্য যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে, সমুদ্রের গভীরতা কমে যাচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাইরাসের আবির্ভাব মানুষের জীবাণু অস্ত্র বানানোর বিপজ্জনক পরীক্ষার ফল।

এ অস্ত্র বানানোর গবেষণা বন্ধ করে ছোট-বড় সব দেশ পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে অবিলম্বে না দাঁড়ালে গোটা মানবসভ্যতা বর্তমান কোভিড-১৯-এর চেয়েও ভয়াবহ বিপদে অস্তিত্ব হারানোর মুখোমুখি হবে।

মানুষই মানুষের শত্রু সৃষ্টি করে। তারপর তা যখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠে, তখন তাকে ধ্বংস করার জন্য হিমশিম খায়। পৃথিবীতে সন্ত্রাস ছিল। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বলে কিছু ছিল না।

কমিউনিজম ঠেকানোর নামে আমেরিকা আফগানিস্তানে মোজাহিদ, তালেবান, আল কায়দা ইত্যাদি সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করে এবং তাদের মারণাস্ত্র ব্যবহারে ট্রেনিং দেয়। আফগানিস্তানের এই সন্ত্রাসও মার্কিন মদদে পুষ্ট হয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসে পরিণত হয় এবং প্রথমেই আঘাত হানে নিউইয়র্কের সুউচ্চ টুইন টাওয়ারে এবং কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু ঘটায়।

এরপর আমেরিকার চৈতন্যোদয় ঘটে। আমেরিকা ইউরোপ ও এশিয়ার মিত্র ও অনুগত দেশগুলো নিয়ে ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে নতুন খেলা শুরু করে।

ফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের কবলে পড়ে সারা বিশ্বকে এখনও ভুগতে হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ছোবল থেকে আমেরিকাও বাঁচতে পেরেছে কি? নিজের সুপার-পাওয়ার সম্মান বাঁচাতে পেরেছে কি?

আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সৃষ্ট তালেবানদের ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা তার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়েছে। মিলিয়ন নয়, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। কয়েক হাজার মার্কিন সৈন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছে।

সেই যুদ্ধে আমেরিকা জয়ী হতে পেরেছে কি? সম্প্রতি চরমশত্রু তালেবানদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি করতে গিয়ে ট্রাম্প সাহেবকে তার ঔদ্ধত্য বিসর্জন দিতে হয়েছে। যারা বলেছিলেন, আফগানিস্তান হবে আমেরিকার জন্য দ্বিতীয় ভিয়েতনাম, তাদের কথাই সত্য হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমনের জন্য আমেরিকা যেমন মিত্রদের নিয়ে মেকি প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, বর্তমানের ভয়াবহ ব্যাধিসন্ত্রাস দমনে যদি সেই মেকি ঐক্যের বদলে শত্রুমিত্র সব দেশকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের সেই ঐক্যে মিলিত করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করে, জীবাণু-অস্ত্র বানানো নিয়ে গোপন গবেষণা অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই ভাইরাসকে দমন করা সম্ভব।

লন্ডন, ৭ মার্চ