এইচএসসিতে এবার সেট বাড়ছে, কমছে কেন্দ্র

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়েই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছিল। কোনো পদক্ষেপেই তা থামানো যায়নি। তাই আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় একগুচ্ছ পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে—প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বাড়তি সেট রাখা, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা শতাধিক কেন্দ্র বাতিল করা, ডাবল প্যাকেটে প্রশ্ন বিতরণ এবং ট্রেজারিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক রাখা প্রভৃতি।

নতুন করে এসব ব্যবস্থা নিতে পারলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো সম্ভব হবে বলে আশা করছেন মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এত দিন পরীক্ষার জন্য চার সেট প্রশ্ন করে লটারির মাধ্যমে দুই সেট ছাপানো হতো। কোনো কারণে এক সেটের ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে অন্য সেটে পরীক্ষা নেওয়া হতো। কিন্তু এবারের এসএসসি পরীক্ষার সময় দেখা গেছে, দুই সেট প্রশ্নই পরীক্ষার আগে বাইরে চলে এসেছে। তাই এবারের এইচএসসি পরীক্ষা থেকে চার সেট প্রশ্নই ছাপানো হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের হাতে একাধিক বিকল্প থাকবে।

সূত্র আরো জানায়, ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন বিতরণের সময় ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সেটা সব সময় মানা হয় না। অনেক সময়ই অন্য কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। আবার ইউএনও ও ম্যাজিস্ট্রেটরা ট্রেজারিতে গেলেও ভল্টে ঢোকেন না। এবার থেকে প্রশ্নপত্রের ট্রাংক খোলার সময় অবশ্যই সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া আন্তশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবার সুনির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রও চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো থেকে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন বাইরে চলে আসার অভিযোগ রয়েছে। তাই এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রায় দুই হাজার ৫০০ কেন্দ্র থেকে শতাধিক কেন্দ্র কমানো হবে।

তা ছাড়া প্রশ্ন বিতরণ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসছে। প্রত্যন্ত এলাকায় কেন্দ্র থাকায় পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগেই থানা ট্রেজারিতে প্রশ্ন জমা রাখা হয়। এত দিন তিন ধরনের প্যাকেট করা হতো। ২০, ৫০, ১০০ ও ২০০টি প্রশ্ন একত্র করে প্যাকেট সিলগালা করা থাকত। এবার শ্রেণিকক্ষ অনুযায়ী প্রশ্নের প্যাকেট করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে সেটা এবার থেকে সম্ভব না হলেও সিলগালা প্যাকেটের ওপর আরেকটি প্যাকেট রাখা হবে। অর্থাৎ প্রশ্নপত্র বিতরণের সময় ডাবল প্যাকেট করা থাকলে সহজেই কেউ প্যাকেট খুলতে পারবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে, কেবল প্রশাসনিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো কঠিন। এ জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তাই আগামী এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর আগেই সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা আয়োজনে কী কী করণীয় সেসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করবে মন্ত্রণালয়। এবারে শিগগিরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি কলেজকে চিঠি দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এবারের এইচএসসি পরীক্ষার সূচিতেও এরই মধ্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এত দিন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষার আগে এক থেকে দুই দিন ছুটি রাখা হলেও এবার তা থাকছে না। শুধু ইংরেজি দুই পত্রের প্রতিটির আগে এক দিন করে ছুটি রাখা হয়েছে। আর পরীক্ষার এই সময়সূচি নিয়ে পরীক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও এর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্রুত সময়ে পরীক্ষা শেষ করতে চায়। এতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি অনেকটাই কমবে বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়।

চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার মতোই এইচএসসিতেও ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করা হবে। আর কেন্দ্রের আশপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করা হবে।

চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার প্রথম তিনটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলে নড়েচড়ে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সহযোগিতা চায়। সবার সক্রিয়তায় প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী বেশ কিছু চক্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। ফলে প্রথম তিন দিনের তুলনায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপকতা কমে আসে। তাই আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার শুরু থেকেই পুলিশ ও বিটিআরসিকে সক্রিয় রাখতে চাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এরই মধ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী মিলে আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক করেছেন। শিগগিরই এই তিন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করা হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই তিন মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কাজ করবে।

গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা থেকেই বেশ কিছু পরিবর্তনের আভাস দেন। তিনি বলেন, ‘আসন্ন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে আমরা আরো কঠোর হব। এতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন না হলেও পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে। আর আগামী বছর থেকে বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করব। তবে সব কিছুই হবে শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে।’

আর গত রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সচিবালয়ে এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আমাদের চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। তাই প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ও সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা আয়োজনে এইচএসসি পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিগত বছরের চেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন সেট বাড়ানো হবে। যাতে কোনো একটি সেট ফাঁস হলেও সহজেই অন্য সেটে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়। এ এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিতরণে প্যাকেটিংও নতুনভাবে করা হবে।’

তবে আগামী বছর থেকে পরীক্ষা পদ্ধতির পুরোটাই সংস্কারের আভাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব। এসএসসি ও এইচএসসির বহুনির্বাচনী অংশের পুরোটাই তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ব্যাংক করে সেখান থেকে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন করে তা কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছাপানো, ডিভাইসের মাধ্যমে পাঠানো বা অন্য কোনো উপায়ে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায় সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে।

এ ছাড়া বিজি প্রেস থেকে পাঠানো প্রশ্নের প্যাকেটও কোনো ডিভাইস দিয়ে লক করে পাঠানো যায় কি না তাও ভাবা হচ্ছে। যাতে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কেউ প্রশ্নের প্যাকেট খুললে সহজেই ধরে ফেলা যায়।

আর সম্প্রতি হাইকোর্টও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সুপারিশ করার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদকে প্রধান করে একটি প্রশাসনিক কমিটি করে দিয়েছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এত কিছু পরিবর্তনের আভাসের পরও আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীপা সুলতানা বলেন, ‘এসএসসিতে নানা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যায়নি। এখন যদি এইচএসসিতেও এমন অবস্থা হয় তাহলে মেধাবীদের পড়ালেখার কোনো মূল্য থাকবে না। আমরা আর প্রশ্ন ফাঁস চাই না। আর এই দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।’

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় একগুচ্ছ পরিবর্তন আনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যেকোনো উপায়ে এইচএসসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে চাই। এ জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি।’ কালের কণ্ঠ