উচ্চ শিক্ষার ফেরিওয়ালা

স্বপ্ন দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। হয়েছিও তাই। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। বরং গর্বিত। কিন্তু বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বাদে যেখানে গবেষণার ক্ষেত্র একেবারে অপ্রতুল। সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। সুযোগ সুবিধা বলতে বেতন কাঠামো, প্রমোশন, আবাসিক সুবিধা, চিকিৎসা ইত্যাদি বুঝিয়েছি। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে অল্প পরিমানে হলেও বই কেনার জন্য টাকা দেয়া হয় সেখানে বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যলয়ে এরকম সুযোগের কথা কল্পনাই করা যায় না। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানে কোন চাকুরি নীতিমালা নেই। নেই কোন গবেষণা প্রণোদনা। তাই সর্বোচ্চ মেধাবিরা এ পেশায় এসেও হতাশ হয়ে ফিরে যায়। বে-সরকালী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা মোতাবেক এটি একটি ট্রাস্ট। তাই এ প্রতিষ্ঠানের যেকোন প্রয়োজনে টাকা লাগলে এর উদ্যোক্তাতারা নিজেদের তহবিল থেকে তা সরবরাহ করবে। নিজেরা সেখান থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ অর্থাৎ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) বিশ্ববিদ্যালয় চালু করবার পর এখানে Break-even শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন যা সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায় পরিভাষা। এবং এ অবস্থানে পৌঁছার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। শিক্ষাকে বিক্রি করে যেনতেন একটি পন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাই আমি মনে করি, এই শব্দ ব্যবহারকারীরা কখনো জাতিকে একটি আদর্শমানের বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিতে পারে না। তাদের হাতে অবশ্যই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে ব্যবসাবিদ্যালয়ের গঠিত হয়ে উঠবে। যা একটি জাতিকে কঠিন বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মানুষের সৃজনশীলতা শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনবে।
শিক্ষাখাতে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দুর্বৃত্তায়ন আমাকে উপর্যুক্ত এমন একটি কঠিন শিরোনাম নিতে বাধ্য করেছে। অতি সম্প্রতি পত্র-পত্রিকা (বিডিনিউজ২৪.কম, ২০/০১/২০১৭) মারফত জানতে পারলাম সরকার দেশের সপ্তম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা যোগাতে বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরিক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীদের সরকারী চিঠি, বই ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবে। সরকারের এমন প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে আমাদের আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যপক সাহস সঞ্চার করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, দুঃখে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে যখন আমরা দেখতে পায় কোমলমতি ওই শিক্ষার্থীদের হাতে যখন ভুলে ভরা বই তুলে দেয়া হয়। সরকারে কঠোর প্রচেষ্টায় যখন বছরের প্রথম দিনে এদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই দিতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক সে সময় শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অবহেলা সহ্য করবার মতো নয়। কতিপয় অদক্ষ, অসৎ পদলোভিদের জন্য আমাদের সব অর্জন আমরা মাটিতে লুটিয়ে দিতে পারি না। শুধু এটুকুই নয় শিক্ষকদের অবহেলা, অদক্ষতা, অতিরুক্ত ফি গ্রহণ, নিন্মমানের শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি প্রতিনিয়ত দেশের গণমাধ্যমে শিক্ষাখাতের বেহাল দশার কথা তুলে ধরা হচ্ছে। সম্প্রতি বে-সরকারী গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের অধিকাংশ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে। শিক্ষকরা ঠিকমত ক্লাশ পরিক্ষা নেন না। গবেষণা করেন না। গবেষণা প্রস্তাব চেয়ে মঞ্জুরি কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিলেও আবেদনের স্বল্পতার কারণে অনেক টাকা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের বে-সরকারী খাতে প্রতিষ্ঠিত বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে শিক্ষা বিষয়ক দুর্নীতি, সরকারী নীতিমালা না মানা, শিক্ষার মান উন্নয়ন না করে নিজেদের ইচ্ছেমত পাঠদান ইত্যাদি বিষয়ও ফলাও করে তুলে ধরা হয়েছে। দেশে বর্তমানে ৯৫টি বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে কিছু সংখ্যক একেবারে নতুন। এগুলো বাদেও পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের জন্য নির্ধরিত সময় অতিবাহিত হলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়ার প্রসঙ্গও তো রয়েছে। আর দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক অনুমোদনহীন শাখা ক্যাম্পাস বে-সরকারী খাতে উচ্চ শিক্ষাকে হাজারো প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছে। তবে আর নয়। এখন সময় এসেছে এসব সমস্য সমাধানের।
আমাদের স্বপ্ন ছিলো এদেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয় হবে যেখানে চোখ মেলে তাকালে দুই-চারজন নোবেল বিজয়ী শিক্ষক ও গবেষকদের দেখা মিলবে। কিন্তু তা আমাদের দেশে হয়নি। বর্তমান বেহাল দশা অদূর ভবিষ্যতেও কোন সম্ভবনার ইঙ্গিত দেয় না। আজকে আমাদের দেশের কিছু নামকরা শিক্ষাবিদরা উপার্জনের নামে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম-গঞ্জের মোড়ে মোড়ে শিক্ষাকে পন্য বানিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন দেশী-বিদেশী উচ্চাভিলাশী শব্দ চয়ন করে। নিজের নামটিও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লিখে দিয়েছেন। বাঘা বাঘা এসব শিক্ষাবিদরা হয়েছেন আজ বড় বড় ফেরিওয়ালা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তাঁরা ফেরি করে শিক্ষা নামক ওই পন্যটি মানুষের হাতে রেডিমেড তুলে খাইয়ে দিবেন। কথাগুলো বললাম এজন্য যে, আজকে দেশের বে-সরকারী বিশ্বদ্যিালয়ের প্রসাশনিক ও একডেমিক কার্যকলাপের সাথে যারা যুক্ত রয়েছেন তারা কেউ কেউ বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত অথবা সেখান থেকে অবসরে রয়েছেন। বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁরা চোখ বুঝে রয়ে যান। মাস শেষে মোটা অংকের বেতন তুলে নিলেই বোধ হয় তাঁদের দায়িত্ব শেষ। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি’র ‘ইয়েস ম্যান’ হয়ে যান। শিক্ষার মান উন্নয়নে যে সমস্ত উপকরণ দরকার তার তাগিদ তারা বিওটি’র নিকট উপস্থাপন  করেন না। মোটা অংকের বেতনের ভারে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা নিজেরাও ফেরিওয়ালা হয়ে যান। শুধু তাই নয় কেউ কেউ আছেন যাঁরা প্রতিষ্ঠিত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্জনের হার দেখে লোভ সংবরণ করতে না পেরে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই বড় করে একটি বিলবোর্ড টাঙিয়ে নিজেই একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হবার স্বপ্ন দেখেন। সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সব বিভাগ থেকে অনুমোদনের নাম করে শিক্ষার্থী ভর্তি করে উচ্চ শিক্ষার মান কুলষিত করছেন। সুযোগ পেলে কেউ কেউ আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বলে প্রচার করে নানা কায়দায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করে সনদ বিক্রি করে নির্লিপ্ত ঘৃর্ন্য কাজের সঙ্গী হচ্ছেন।
সরকার অনেক কঠোর আইন করেও অপরাধকারীদের প্রতিহত করতে পারছেন না। কারণ তাদের হাতে আলউদ্দিনের আচর্য চেরাগের ছোঁয়ায় অনেক টাকা হয়ে যায় যা দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে আদালত থেকে রায় নিয়ে বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠান সমূহ চায়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ধারা ৯-এর উপধারা-৬তে বলা হয়েছে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক বাজেটের ব্যয় খাতে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একটি অংশ গবেষণার জন্য বরাদ্দদপূর্বক উহা ব্যয় করিতে ইইবে। কিন্তু কার্যত এই আইনের বাস্তবায়ন একেবারে অনুপস্থিত। এই আইনের ধারা ১৫-এর উপধারা-৩ এ বলা হয়েছে, সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরীবিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়-সংবিধি অনুমোদনপূবর্ক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে প্রেরণ করবে। এছাড়া এধারার উপধারা-৮ মোতাবেক সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক. শিক্ষার্থী-অভিভাবক, এলামনাই এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সহিত বছরে অন্ততঃ একবার মতবিনিময় সভার আয়োজন এবং সভায় প্রাপ্ত মতামতরে ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে আজ জাতি জঙ্গিবাদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এতোটা আতঙ্কিত হতো না।
বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের অধিকার আদােেয়র সংগঠন (যদিও এধরণের বিধিমালা বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ নেই) থাকলেও সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারি যেমন শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অধিকার আদায়ের কোন সংগঠন করবার সুযোগ নেই। সেই সুবাদে দেশের অধিকাংশ বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ যেনতেন মানের শিক্ষা প্রদানের সুযোগে ফেরিওয়ালাই থেকে যাচ্ছেন। তবে এই আইনের ধারা-৪৬ এর উপধারা-৩এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারিবৃন্দ এমনকি শিক্ষার্থীবৃন্দ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কমিশনের কাছে অভিযোগ দাখিল ও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন।
উচ্চশিক্ষার ফেরিওয়ালাদের এহেন হীনচেষ্টা দূরিকরণে এখনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য আইনে বর্ণীত নানা বিষয় ও সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধিমালা অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের ন্যায় প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকে অথবা সুবিধাজনক স্থানে লিখে স্থায়ীভাবে ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতির নানা পাঠ শিক্ষার্থীদের মাঝে সুবিধাজনক উপায়ে জানিয়ে দিতে হবে। দেশের সৎ, নির্ভীক ও সত্যিকারের গবেষকদের দ্বারা একটি কমিটি করে সরকারীভাবে এগুলে তদারকির জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালরয় মঞ্জুরি কমিশনকে সজাগ থাকতে হবে। বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বিরুদ্ধে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের মামলা করবার অবাধ সুযোগ থাকবে যাতে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত নীতিমালার তৈরী করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে না পারে। স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণে বাধ্য থাকে। বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার আগে রাজিৈনতক বিবেচনা না করে মালিক পক্ষের সক্ষমতা, ব্যবসায়ি দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে শিক্ষা বিস্তারের সদিচ্ছা, পূর্বঅভিজ্ঞতা বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ওই এলাকার সাধারণ জনগণের মতামত প্রাধান্য পাবে।
শিক্ষাবিদদের হতে হবে বীরের মত। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা সংকটের সম্মুখীন হলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে যাবেন। সমাধনের পথ খুঁজে বের করবে। তাঁরা কোন প্রলোভনে মানসম্মত শিক্ষার  বিপরীতে পন্য-শিক্ষার নিকট মাথা নত করবেন না। সুশিক্ষা বিস্তারে জেগে থাকবেন, ঘুমাবেন না। এমন শিক্ষাবিদদের সংখ্যা কম হলেও এখনো তাঁরা আছেন এই দেশে। তাঁদের হাতে আমাদের স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে। পৃথিবীর নানা দেশের মত বাংলাদেশেও শিক্ষার্থীরা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার পাদপিঠ হিসেবে বেছে নিবে। উচ্চশিক্ষার ওই আদর্শ কারিগরদের জানাই স্যালুট। আর ফেরিওয়ালাদের জন্য সঠিক পথে ফিরে আসার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।

 
লেখক: মো. আব্দুল কুদ্দুস
শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ

সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।
মোবাইল: ০১৭১৭৮৫৪১০৪
ইমেইল: shyamoluits@gmail.com