‘উচ্চশিক্ষিত’ বেকারদের ‘অপরাধ’ কী?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

 

বাংলাদেশে এখন ৪ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ এ মুহূর্তে পড়াশোনা করছে না, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না এবং কোনো কাজকর্মও করছে না। অর্থাৎ এই বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবা জীবনযাপনের জন্য সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞরা জনগোষ্ঠীর এই অংশটির নাম দিয়েছেন ‘নিষ্ক্রিয়’।
এই নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা হলেন সেসব যুবক-যুবতী, যাঁরা ‘উচ্চশিক্ষিত’ কিন্তু বেকার। চাকরি না পাওয়ার ফলে নিজেদের পরিবারের গলগ্রহ ভাবতে ভাবতে তাঁদের মনে যে হতাশা ও গ্লানি জমে ওঠে, তা দুঃসহ। হতাশা তাঁদের মা-বাবাকেও ছাড়ে না। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ছেলের বেকারত্ব মা-বাবার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। (অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত মেয়ের বেকারত্বের সমাধান তাঁরা পেয়ে যান মেয়েটিকে সচ্ছল কোনো পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলে।)

\
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। যাঁর ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ যত বেশি, তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। যাঁরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর যাঁরা অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন, তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আরও একটা লক্ষণীয় তথ্য হলো, কম শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে; কিন্তু বেশি শিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার খুব দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে।

 

উচ্চশিক্ষিত বেকারদের নিয়েও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয়, এত অনার্স-মাস্টার ডিগ্রিধারী লোকের দরকার আছে কি না, তা কেউ ভেবে দেখে না

সিডারের ওই প্রতিবেদন বলছে, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষিত বেকারের হার ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে কমে গেছে। কিন্তু একই সময়ে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্ব সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। ২০১০ সালে অনার্স-মাস্টার ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা হয়েছে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। মাত্র তিন বছরের মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশ বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া গুরুতর কোনো সমস্যার ইঙ্গিতবাহী হতে পারে। হতে পারে এই সময়ের মধ্যে আরও বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী অনার্স-মাস্টার্স পাস করে বেরিয়েছেন, কিন্তু শ্রমবাজারে তাঁদের স্থান মেলেনি, বরং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের শ্রমবাজার হয়তো আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে।
তারপর আরও তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়কালে দেশের অর্থনীতিতে বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি, বরং বিনিয়োগে স্থবিরতা অব্যাহত আছে। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধির উল্লিখিত প্রবণতা যদি গত তিন বছরেও অব্যাহত থেকে থাকে, তাহলে আজ এই ২০১৭ সালে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের বেকারত্বের হার বেড়ে ২০ শতাংশ পেরিয়ে যাওয়ার কথা।
নতুন সহস্রাব্দে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান শ্রমশক্তি বলে মনে করা হচ্ছে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই নিষ্ক্রিয়। সংখ্যায় তঁারা এক কোটিরও বেশি। পৃথিবীর অনেক দেশেই মোট জনসংখ্যা এক কোটি নয়। আমাদের এই বিপুল নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠী জাতীয় অর্থনীতির ওপর এক বিরাট বোঝা। যতই দিন যাবে, এই বোঝার ভার ও আকার ততই বাড়তে থাকবে। কিন্তু তাদের নিয়ে কী করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সমস্যা বলে মনে করা হয়; বরং বলা হয় বেশি জনসংখ্যা আমাদের সম্পদ।
উচ্চশিক্ষিত বেকারদের নিয়েও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয়, এত অনার্স-মাস্টার ডিগ্রিধারী লোকের দরকার আছে কি না, তা কেউ ভেবে দেখে না। প্রতিবছর হাজার হাজার যুবক-যুবতী মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে এসে কোথায় কী কাজ করবেন, সে চিন্তাও কেউ করে বলে মনে হয় না। দরিদ্র মা-বাবার কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আট বছর ধরে দর্শনশাস্ত্র পড়ে একখানা মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি পাওয়ার জন্য লাখ টাকা ঘুষ দিতে প্রস্তুত, তবু চাকরি মিলছে না—আমার দেশের উচ্চশিক্ষিত যুবসমাজের জন্য এহেন করুণ দুর্দশায় আমরা কেন ও কী করে পৌঁছালাম, এর জন্য কারা দায়ী এবং এই দুর্দশা থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি, তা নিয়ে গভীর গবেষণা হওয়া জরুরি।
বিশ্ব শ্রম সংস্থার এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখলাম, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-উদ্যোক্তা সমাজের ৭৫ শতাংশ বলেছে, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগ করতে চায়, কিন্তু প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ লোক পায় না। শিল্পপতি মঞ্জুর এলাহী একবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট। তিনি মনে করেন, এ দেশের ‘উচ্চশিক্ষা’র মান ভালো নয়।
ঢাকার সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী একবার প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের দেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রতি মনোযোগী নয়।’ তিনি আরও বলেন, এত বেশিসংখ্যক ছেলেমেয়ের অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বিভিন্ন কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।\
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি পাস করেছেন, এমন এক তরুণ ঢাকার হাতিরঝিলের পাড়ে একটা প্লাস্টিকের টেবিল পেতে লোকজনের রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা মেপে কিছু পয়সা আয় করেন। মাস্টার্স পাস করতে তাঁর লেগেছে সাড়ে আট বছর। কিন্তু এখন কোনো চাকরি পাচ্ছেন না, পাবেন যে এমন আশাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘কী? চাকরি হলো?’ বেচারি করুণ হেসে বলেন, ‘কই আর হলো? দেশে কি চাকরি আছে?’ তাঁর নিজেই নিজেকে ভৎ৴সনা করছেন, এমন ভঙ্গিতে নিজেকে স্ত্রীর ভাই সম্বোধন করে বলেন, ‘…কোন আক্কেলে যে মাস্টার্স পড়তে গেছলাম! নাইলে তো বাড়ি ফিরত গিয়া চাষবাস করতে পারতাম!’

মশিউল আলম:সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

 

সূত্রঃপ্রথম আলো