ঈদে নতুন পোষাক পরা ইসলামে আবশ্যক নয়

ঈদের দিনের কিছু সুন্নাত রয়েছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দুই ঈদের বিধানের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্যও আছে।

সামনে ঈদুল ফিতর সমাগত; তাই ঈদুল ফিতরের দিন কী কী কাজ করতে হবে তা জেনে নেয়া যাক।

ইমাম তহাভি (রহ.) লিখেন, ঈদুল ফিতরের সকালে কয়েকটি কাজ করা মুস্তাহাব। গোসল করা, মিসওয়াক করা, সুগন্ধি লাগানো, সদকাতুল ফিতর আদায় করা, ঈদের নামাজ পড়তে বের হবার আগে কিছু খেয়ে নেয়া এবং কাছে থাকা পোষাকসমূহের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর পোষাক পরিধান করা। (শারহু মুখতাসারুত তাহাবি ২/১৪৯)

ইমাম তাহাভি ছাড়া অন্য সব মুহাদ্দিস বা ফকীহও একই কথা বলেছেন। নতুন পোষাক নয় প্রত্যেকের কাছে যে কাপড়গুলো আছে এর ভেতর সুন্দরটা পরিধান করবে।

ফিকহের কিতাব থেকে উদ্ধৃতি টানতে হল, কারণ হাদিসে নতুন কাপড় পরিধানের বিষয়ে তেমন কিছুই বর্ণিত হয়নি।
ইমাম বুখারী (রহ.) একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, একবার হজরত উমর (রা.) মদীনার বাজার থেকে একটি রেশমের কাপড় আনলেন রাসুলের (সা.) জন্য।

হজরত উমর নবীজীকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এ পোষাকটি আপনি ঈদের দিন এবং বাইরে থেকে বিভিন্ন কবিলার প্রতিনিধি দল আসলে পরিধান করবেন। রাসুল (সা.) হজরত উমরকে (রা.) বললেন, এ পোষাক পরিধান করবে সে ব্যক্তি আখেরাতে যার কোনো অংশ নেই। (বুখারী, হাদিস নং ৯৪৮)

রেশমের কাপড় হওয়ার কারণে রাসুল (সা.) পোষাকটি গ্রহণ করেননি। কারণ ইসলামী শরিয়তে পুরুষের জন্য রেশম পরিধান করা নিষিদ্ধ। নারীরা রেশম ব্যবহার করতে পারে।

হজরত উমরের (রা.) হাদিসে দেখা যাচ্ছে, রাসুলের (সা.) জন্য একটি নতুন পোষাক কিনে আনা হয়েছিল কিন্তু তিনি সে পোষাক পরেননি। অন্য কোনো বর্ণনায়ও রাসুল (সা.) ঈদের দিন নতুন পোষাক পরেছেন বলে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।

কিন্তু আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজে নতুন পোষাক পরার রেওয়াজ চলে আসছে বহু দিন ধরে। সাহাবিদের যুগের যেসব বর্ণনা পাই সেখানেও দেখা যাচ্ছে তারা ঈদের দিন তাদের কাছে থাকা উৎকৃষ্ট কাপড় পরতেন। (বাইহাকি দ্রষ্টব্য)

নতুন কাপড় কেনার কোনো কথা সাহাবি যুগেও পাওয়া যায় না। তবে অবশ্যই নতুন কাপড় কেনার অনুমতি রয়েছে। ইসলামী শরিয়াতে এতে কোনো বাধাও নেই। যে কেউ যে কোনো সময় কাপড় কিনতে পারে।

ঈদের সময় আনন্দ প্রকাশের জন্য নতুন কাপড় কিনতেই পারে। এটাকে সুন্নাত না মনে করলেই হলো। সমাজে কেউ সুন্নাত মনে করে নতুন কাপড় ক্রয় করে বলে মনে হয় না। ঈদ উপলক্ষে মার্কেটে যাওয়া যাবে না এমন ফতোয়া দেয়া ঠিক হবে না।

শরীয়াতে কেবল একটি নির্দেশনা দেয়া আছে, আর তা হচ্ছে ইসরাফ না করার কথা। অর্থাৎ পোষাক সংগ্রহ করতে খুব বাড়াবাড়ি না করা। অপচয় বা অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকা ইসলামের শিক্ষা।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, হে বনি আদম, প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান করবে, পানাহার করবে কিন্তু অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদেরকে পসন্দ করেন না। (আরাফ, আয়াত: ৩১)

বিত্তশালিরা ঈদের সময় মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে যে অতিরঞ্জন করে তা অনেক ক্ষেত্রে ইসরাফের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় কি না তা ভেবে দেখা উচিত।

এখন যে সময়ে আমরা অবস্থান করছি এ পরিস্থিতিতে অপচয় নয়; অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সবার চোখ। করোনাভাইরাসের ভয়ে সবাই আমরা ভীত হয়ে আছি। তারপরও মার্কেট করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
নতুন পোষাক ছাড়া কি ঈদ হয়- এমন একটা মনোভাব শয়তান আমাদের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঈদটা ঈদের মত করে উদযাপন করতে না পারলে আমি কেমন মুসলমান? মার্কেটগুলোতে ভীড় বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

কোনো ভাইরাসের ভয় বাধা দিয়ে রাখতে পারছে না শহরের মানুষদের। গ্রামেও হয়ত আছে এই প্রবণতা কিন্তু শহরে এ ঝোঁকটা একটু বেশি। আল্লাহ সবাইকে সুমতি দিন; এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই। ফতোয়ার কিতাবের ভাষ্য দিয়ে কি আর ফিরিয়ে রাখা যাবে অবিবেচক মানুষদের?

মূলত ঈদের তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম আজকের মুসলিম। পবিত্র ঈদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। নতুন কাপড় পরার নামই ঈদ নয়।

ঈদের খুতবায় খতিবরা ঈদের দিন এই লাইনটিও বলেন, লাইসাল ঈদু লুবসুল জাদিদ.. নতুন পোষাক পরার নাম ঈদ নয়। মনকে নতুন করতে হবে। নতুন করে শুরু করতে হবে জীবন। মনকে নতুন করা হচ্ছে ঈদের আধ্যাত্মিক দিক। সব ধরনের পাপ চিন্তা থেকে মনকে পরিচ্ছন্ন করে ফেলতে হবে।

সামাজিক দিক হচ্ছে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী ও বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো ও তাদেরকে দাওয়াত করা। সালামি দেয়া, ঈদের শুভেচ্ছা জানানো এবং আরও যেসব সামাজিক বিষয় আছে সেগুলো সম্পন্ন করা। হাদিসেও এর নির্দেশনা রয়েছে।

আর ঈদের মানবিক দিক হচ্ছে আনন্দটা সুবিধা বঞ্চিত দুস্থ অসহায় সব মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেয়া। একা একা ঈদ করা নয় অন্য সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ করা। ঈদের আনন্দে সব মানুষকে শরিক করা।

এই তিনটি হচ্ছে ইদের প্রাণ। আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও মানবিক ভাবনাহীন ঈদ মগজহীন খোলসের মতই। মার্কেটে না গেলে ঈদ হবে না এমন নয়। কিন্তু এই তিনটি বিষয় না হলে ঈদ নয়; আপনার জন্য ওয়াইদ অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে ধমকি রয়েছে।

করোনার কারণে পথের সঙ্গে মিশে গেছে অনেক পরিবার। তাদের কাছে নতুন কাপড় কেনা তো দূরের কথা, দু বেলা খাওয়ার মত চালটাও নেই। মার্কেট কম করে এবারের ঈদে আসুন দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষদের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করার চেষ্টা করি।

সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে চলার কথা স্বাস্থ অধিদফতর থেকে আপনার আমার কল্যাণের জন্যই দেয়া হচ্ছে যথা সম্ভব তা আমাদের সবার মেনে চলা উচিত। বেঁচে থাকলে করোনামুক্ত পৃথিবীতে অনেক ঈদ পাবো আমরা। তখন না হয় মন ভরে শপিং করতে পারব। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

সূত্রঃ যুগান্তর