ঈদের আমেজে স্বাস্থ্যবিধি শিকেয়

বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা মহামারি। বর্তমানে বাংলাদেশে এই মহামারির ঊর্ধ্বগতি। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানায় প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। স্বজন হারানোর বেদনায় দেশজুড়ে মানুষের হাহাকার। হাসপাতালে হাসপাতালে, বাড়িতে বাড়িতে করোনা রোগী ও চিকিৎসাকর্মীদের বেঁচে থাকার অনিঃশেষ লড়াই। এর মধ্যেই এসেছে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। অন্য রকম এক বিষাদময় পরিবেশে আগামীকাল বুধবার পালিত হবে ঈদুল আজহা।

একদিকে মানুষ যখন কোরবানির পশু কেনায় ব্যস্ত, তখন রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাবর রোডে আল মারকাজুল ইসলামের ভেতরে-বাইরে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সারি। শেষ গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে একদিকে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে মৃতদেহ, আরেকদিকে লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে গোসলের জায়গায়। আর পাশের আবাসিক ভবনগুলোর নিচে কিংবা পার্কিং জোনে রাখা অগণন কোরবানির পশু। কোরবানির পশুর হাম্বা রবের সঙ্গে মারকাজুলের সামনে মৃতদের স্বজনদের আহাজারি মিলে গভীর এক বিষাদ তৈরি করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় আল মারকাজুলের ডিউটি অফিসার আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৩ জনের গোসল ও কফিন প্রস্তুত করে দিয়েছেন তাঁরা। অপেক্ষমাণ আছে আরো কয়েকজনের মরদেহ।

শুধু মোহাম্মদপুরের মারকাজুলে নয়, গতকাল দেশে করোনায় এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ মারা যাওয়া ২৩১ জনের শবদেহ নিয়ে স্বজনদের ছোটাছুটি ছিল হাসপাতালে, বাড়িতে, শেষকৃত্যে। এসবে যেন সামান্য ভ্রুক্ষেপও নেই অন্যদের। সবাই ব্যস্ত ঈদ আয়োজনে। যেন মহামারি পূর্বপরিস্থিতি ফিরেছে দেশে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কায় কভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বিধি-নিষেধ শিথিল করায় আপত্তি তুলেছিলেন। তবে সরকার ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ চলার প্রধান শর্তসহ আরো বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে গত ১৪ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বিধি-নিষেধ শিথিল করে। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বোচ্চ চূড়ায় থাকা অবস্থায় সরকারঘোষিত ৯ দিনের এই ‘শিথিলতার’ চরম অপব্যবহার লক্ষণীয় সবখানে। বিধি-নিষেধের শর্ত ভুলে রীতিমতো স্বস্তির পরিবেশে ঈদ আয়োজনে ব্যস্ত মানুষ। চলাফেরা, কেনাকাটা, হাট-বাজার, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার সামান্য বালাই নেই। প্রশাসনও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা।

কোরবানির পশুর হাট থেকে শুরু করে বাড়ি, পাড়া-মহল্লায় একই চিত্র। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার উদ্যোগের প্রভাবও পড়েনি পশুর হাটে। দুই সিটি করপোরেশন নির্ধারিত হাটগুলো ছাড়াও অলিগলিতে, রাজপথে প্রকাশ্যে চলছে কোরবানির পশু বেচাকেনা। এই পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের এই অবহেলার পরিণতি দেখা যাবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। তাঁরা ধারণা করছেন, সংক্রমণের পেছনের সব রেকর্ড ভেঙে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যুও আরো ঊর্ধ্বগতির হবে।

কোরবানির পশুর হাট, পোশাকের দোকান, ঘরমুখো মানুষের ঢল, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখে বোঝার উপায় নেই দেশ মহামারি মোকাবেলা করছে। বরং সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে মানুষ যেন করোনাপূর্ব স্বাভাবিক ঈদ পালনে প্রস্তুত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকার গঠিত কারিগরি পরামর্শক কমিটির সিনিয়র সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করে  বলেন, ‘মানুষ যেন কেমন হয়ে গেছে! সবাই দেখছে হাসপাতালের কী অবস্থা! দিন-রাত ছুটছে করোনায় মৃতদের লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স। অথচ মানুষ এসবে তোয়াক্কা না করে ছুটছে কোরবানির গরু কিনতে, কেউ ছুটছে নতুন জামা-কাপড় কিনতে, কেউ ছুটছে গ্রামের বাড়ি। এটা রীতিমতো মানবিক-নৈতিক সংকট।’

ডা. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘সরকার বিধি-নিষেধ শিথিল করেছে, তুলে তো দেওয়া হয়নি। মানুষ কেন এত বেপরোয়া হবে? প্রশাসনও হাল ছাড়বে কেন? লকডাউন শিথিল করলেও প্রশাসনের অভিযান জোরদার থাকাই দরকার ছিল। টিভিতে দেখছি মানুষ মাস্ক ছাড়াই গরুর হাটে ঘুরছে, কিভাবে এটা সম্ভব!’

বর্তমান পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন  বলেন, ‘সরকার যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে ঈদকে সামনে রেখে বিধি-নিষেধ সাময়িক শিথিল করেছে, সেই সুযোগটি মানুষ সঠিকভাবে মানছে না। স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাই মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মাস্ক পরছে না। মানুষের সহযোগিতা ছাড়া প্রশাসনের পক্ষে বিপুল এই জনগোষ্ঠীর অসচেতনতা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘সরকারের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের তুলনায় নির্দেশনা অমান্য করা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।’ রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন  বলেন, ‘যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে আগস্টের প্রথম থেকে সংক্রমণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়তে থাকবে, আর আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাড়তে থাকবে মৃত্যু।

এদিকে গতকাল রাজধানীতে কোরবানির পশু বেচাকেনা, শপিং মলগুলোয় মানুষের উপচেপড়া ভিড় আর রাজধানী ছেড়ে যাওয়া মানুষের চাপে দিনভর সড়কগুলোয় ছিল তীব্র যানজট ও জনজট। রীতিমতো রাজধানীর কোনো কোনো এলাকা অচল হয়ে পড়ে। মানুষের ভোগান্তিও ছিল সীমাহীন।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ