ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জোর করে বন্ধ করা হচ্ছে চীনে!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

চীনে মসজিদে মসজিদে নিয়মিত কোরআন পাঠ করা হতো। ছোটদের সামনে তুলে ধরা হতো ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক, ধর্মীয় শিক্ষার দিক। পাশাপাশি নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রসারে মসজিদগুলো হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রস্থল। প্রায় প্রতিটি মসজিদই ছিল স্কুল। কিন্তু চীন সরকারের দমননীতির জন্য এখন ধর্মশিক্ষার স্কুলও কমে আসছে। চীনের মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক পত্রিকা ‘বিটার উইন্টার’-এ এমনই তথ্য তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক লি ওয়েংশেং। প্রতিবেদনে সাফ বলা হয়েছে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। তাই মসজিদের স্কুলগুলোর সংখ্যাও কমে আসছে দিন দিন।

কমিউনিস্ট শাসনে চীনে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস, শিক্ষা বা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিন্দুমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস নেই সিসিপির। তাই ধর্মশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোই বন্ধ করে দিচ্ছে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আস্থা রাখাটাই চীনা সরকারের কাছে পাপ হিসেবে ধরা হচ্ছে। মুসলিমরা ভুলতে বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের ভাষা, শিক্ষা বা সংস্কৃতি। দেশটির উত্তর-পশ্চিমের চিংহাই এবং গানসু এবং নিংজিয়া হুই স্বশাসিত এলাকা থেকে মুসলিম ধর্মচর্চা নির্মূল করাই এখন সিসিপির প্রধান লক্ষ্য। কারণ, হুই মুসলিমরা এখানে সংখ্যাগুরু। তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনে চীন চায় হুইদেরকেও গায়ের জোরে কমিউনিজমের আদর্শে দিক্ষিত করতে।

চিংহাই প্রদেশের বছর ষাটের এক বৃদ্ধ বিটার উইন্টার-কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরে তিনি নিজেই দেখেছেন, মসজিদ থেকে বহু কিশোর লোটা-কম্বল নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। হাইডঙের মিনহে হুই ও তু শহরে এমন ঘটনা ঘটছে। মসজিদে ইসলামিক স্কুলের ছাত্ররা পড়াশোনো ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তাদের স্কুল বন্ধ করে দিচ্ছে চীন সরকার। মাঝপথে পড়া ছেড়ে তারা ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। শিক্ষার্থীদের কোনো কিছু বলারও সুযোগ নেই। হঠাৎ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এসে মসজিদের স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে যেতে বলছেন। স্কুলে ঝোলানো হচ্ছে তালা। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা কেউ স্কুল ছাড়তে চায়নি। কিন্তু কমিউনিস্টরা কোরআন পড়তে দেবে না। তারা চায় না আমাদের ছেলে-মেয়েরা ধর্মশিক্ষা পাক। আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

তিনি জানান, প্রতিটি স্কুলে বছরে অন্তত জনা ষাটেক ছাত্র হতো। কিন্তু এখন সব বন্ধ। গোপনেও কোরআনের শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না ছেলে-মেয়েদের। কারণ মসজিদে মসজিদে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে প্রশাসন। চলছে কড়া নজরদারি।

লানজুয়ের হংকগু জেলার হাইশিওয়ান মসজিদেও নাটকীয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল। গত এপ্রিলে জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ, গণনিরাপত্তা ব্যুরো বা ধর্মবিষয়ক ব্যুরোর কর্মকর্তা বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময়ে চীনা কর্মকর্তারা হানা দেন মসজিদে। ‘গণ অপরাধ দমন’ বা ‘অশান্তি সৃষ্টিকারীদের উচ্ছেদ’ অভিযানের নামে ইসলামিক শিক্ষা বন্ধ করে দেন তারা। এখানে ইসলামিক শিক্ষার তিনটি ক্লাস হতো। প্রতিটি ক্লাসে অন্তত জনা পঁচিশেক শিক্ষার্থী ছিল। সব বয়সী ছেলে-মেয়েদের ইসলামিক শিক্ষাদানের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায় চীন সরকারের কারণে। তারা এখন কী করবেন, তা জানতে চেয়ে মসজিদের ইমামকে প্রশ্ন করেছিলেন বিটার উইন্টার-এর প্রতিনিধি। পুলিশের ভয়ে ভীত ইমাম শুধু বলেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সরকার এখন দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে অস্বীকার করেন।

এমনকি মসজিদে সমবেত তরুণরাও কোনো মন্তব্য করতে ভয় পায়। সবারই চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। পাশের একটি মসজিদে দুই যুবককে তাঁরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইসলামিক শিক্ষা তাদের হচ্ছে কি না। প্রশ্ন শুনেই আঁতকে ওঠেন দুই যুবকই। তাঁরা বলেন, ‘না-না, আমরা এখানে এসেছি শুধুই মসজিদ পরিষ্কার করতে। ইসলামী শিক্ষার প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।’ তাঁদের চেহারায় ধরা পড়ে আতঙ্কের ছবি।

ইমাম জানিয়েছেন, নিংজিয়ার টঙ্গক্সিন এলাকায় গোপনে ইসলামী শিক্ষা দিতে গিয়ে এক ব্যক্তিকে ছয় বছরের জন্য জেলে পাঠানো হয়েছে। তাই গোপনেও ধর্মশিক্ষা দানের চেষ্টা তাঁরা করতে পারছেন না। ধরা পড়লেই নেমে আসছে কড়া শাস্তি। নজরদারি চলছে সর্বত্র। কোরআন পাঠ করলেই তার বিরুদ্ধে উঠছে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ।

নিংজিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পিংলু কাউন্টিতে রয়েছে অতি প্রাচীন নানচাংকু মসজিদ। শিজুইশন শহরে অবস্থিত তিনশ বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যশালী মসজিদটিরও ইসলামিক শিক্ষাদান ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ। চীন সরকারের ফতোয়ার জেরে স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। বিটার উইন্টার-কে ইমাম জানিয়েছেন, ‘মেয়েদের স্কুলের মতো বহু মসজিদের দরজা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। স্কুল খোলা থাকলেও বেশিক্ষণ ক্লাস চালানো যায় না।’ তিনি জানান, ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে বসেও পড়তে পারছে না। কারণ সেখানেও নজরদারি রয়েছে পুলিশের।

লিঙ্গউ শহরের উজিয়জয়াং ইসলামিক স্কুলও ২০১৮-্এর মার্চ থেকে বন্ধ। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশেই বন্ধ করতে হয়েছে স্কুলটি। স্কুল বন্ধ না করলে হুমকি দেওয়া হয়েছিল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্কুল বিল্ডিং মাটিতে লুটিয়ে দেওয়ার। সঙ্গে ছিল শিক্ষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের হুমকিও। আসলে চীনের সর্বত্রই চলছে ইসলাম ধর্মশিক্ষার ওপর ভয়ংকর আক্রমণ।

ইসলাম শিক্ষাকেই সিসিপি মনে করছে সন্ত্রাসবাদের প্রথম পাঠ। মসজিদের স্কুলগুলোর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী শিবিরের তুলনা টানা হচ্ছে, চলছে দমন-পীড়ন। কোনো অবস্থায়ই কোরআন পাঠকে বরদাস্ত করতে চায় না চীন। কমিউনিস্ট শাসনে চীনে ইসলাম ধর্মের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে। মুসলিমরা হারাতে বসেছে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি। পছন্দের পোশাক পরারও অধিকার নেই। বিসর্জন দিতে হচ্ছে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস। অথচ চীন সরকারের এই অমানবিক আচরণ নিয়ে নীরব মুসলিম দুনিয়া। তাই অত্যাচারের মাত্রাও বেড়েই চলেছে চীনে।

 

সূত্র: কালেরকন্ঠ