ইদলিবে আসন্ন যুদ্ধ নিয়ে তুরস্ক এত উদ্বিগ্ন কেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সিরিয়ায় বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ প্রদেশ ইদলিব পুনর্দখল করতে বড় আকারের এক অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে বাশার আল-আসাদের বাহিনী ।

এ অভিযান শুরু হতে না-হতেই বেসামরিক মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা প্রকাশ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো এবং জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো। তাদের উদ্বেগ, ইদলিবে যুদ্ধ বাধলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে । বিশেষ করে উদ্বেগে আছে তুরস্ক। এর একটা প্রাথমিক কারণ – অভিযান শুরু হলেই হাজারে হাজারে বেসামরিক লোক ইদলিব ছেড়ে পালাতে শুরু করবে এবং তাদের চাপ সামলাতে হবে তুরস্ককেই।

কিন্তু শুধু এটাই তুরস্কের উদ্বেগের কারণ নয়, এর গভীরে আছে অনেকগুলো সামরিক ও কৌশলগত হিসেব।

জটিল সব কৌশলগত হিসেব

সিরিয়ার এই প্রক্সি-যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্কসহ একাধিক দেশ ও পরাশক্তি।

বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পেছনে সমর্থন সহযোগিতা দিচ্ছে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির এক জটিল জাল।

তাদের রয়েছে পরস্পরবিরোধী স্বার্থের হিসেব।

তুরস্কও তার একটি, এবং ইদলিবের একাংশে এখন তুরস্কের সামরিক উপস্থিতিও রয়েছে।

ইদলিব পুনর্দখলের মধ্যে দিয়ে বাশার আসাদের সরকার যদি কার্যত পুরো সিরিয়ার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠা করে ফেলে, তাহলে সিরিয়া সংকটে তুরস্কের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাদের সামরিক উপস্থিতি বানচাল হয়ে যেতে পারে।

তুরস্ক সিরিয়া ইদলিব
সিরিয়ার কোথায় কে নিয়ন্ত্রণে – তার মানচিত্র

তুরস্কের কৌশলগত হিসেবগুলো কি?

গত কয়েক বছরে ইদলিবের উত্তরাংশে একটি বড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে তুরস্ক।

গত কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে তারা তাদের মিত্র বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর মধ্যে দিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে।

বাশার আসাদ সরকারের দুই বড় মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে আলোচনার সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই প্রভাবকে কাজে লাগান।

২০১৬ সালে রুশ সমর্থনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী আলেপ্পো অভিযানের সময় তুরস্ক চুপচাপ ছিল।

এর বিনিময়ে তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহীরা জারাবলুস ও আল-বাবে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানের সবুজ সংকেত পেয়ে যায়।

তুরস্ক সিরিয়া ইদলিব
তেহরানের বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাথে এরদোয়ান

পরে গত বছর রাশিয়া ও ইরানের সাথে উত্তেজনা হ্রাস করতে ইদলিবের ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের বাধ্য করে তুরস্ক। এর পর রাশিয়া আবার তুরস্ক-নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে আফরিন থেকে কুর্দি যোদ্ধাদের তাড়িয়ে দিতে বিনা বাধায় যুদ্ধ চালানোর সুযোগ দেয়।

এখন ইদলিবের বিদ্রোহীরা যদি সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কাছে হেরে যায় – তাহলে তুরস্ক এদেরকে দরকষাকষির জন্য ব্যবহার করার সুযোগ হারাবে।

তা ছাড়া তুরস্কের জন্য আরো একটি সম্ভাব্য বিপদ হলো: ইদলিব মুক্ত হবার পরই সিরিয়ার সরকারি বাহিনী তুরস্ক-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো পুনর্দখলের লড়াই শুরু করতে পারে।

কারণ বাশার আসাদের লক্ষ্য হলো ‘সিরিয়ার প্রতি ইঞ্চি মাটি’ পুনরুদ্ধার করা।

তুরস্ক সিরিয়া ইদলিব
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান

রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক কোন সমঝোতা এখনো হয় নি

সে কারণেই ইতিমধ্যে তেহরানে এরদোয়ান-পুতিন-রুহানি বৈঠক হয়েছে – কিন্তু এই ইদলিব প্রসঙ্গে এখনো রাশিয়া ও ইরানের সাথে তুরস্কের কোন সমঝোতা হয় নি।

তারা শুধু একটি বিষয়েই একমত হয়েছেন – আর তা হলো : এরা তিন জনই সিরিয়ার মাটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি, এবং মার্কিন-সমর্থিত কুর্দি ও আরব মিলিশিয়াদের বিরোধী।

সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স নামে এ বাহিনী সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

সে কারণে ইদলিবে রুশ-সমর্থিত বাশার আসাদের বাহিনীর পুর্ণমাত্রার অভিযান শুরু হলে তা হবে তুরস্ক-রাশিয়া সহযোগিতার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা।

তুরস্ক সিরিয়া ইদলিব
তুরস্কের সৈন্যরা ইদলিবে অবস্থান সংহত করছে

রাশিয়া কি তুরস্ককে পাশে রাখতে চায়?

তবে রাশিয়া হযতো শেষ পর্যন্ত চাইবে তুরস্ককে তার পাশে রাখতে – যদিও তাদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে – এ কথা বলছেন গালিব দালাই, ইস্তাম্বুল ভিত্তিক আল-শারক ফোরাম নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক।

তবে সমস্যা হলো, রাশিয়া বা ইরানের সাথে দরকষাকষি করার মতো মালমশলা তুরস্কের হাতে খুব বেশি নেই।

ইদলিবে সক্রিয় রয়েছে আলকায়েদা-সংশ্লিষ্ট জিহাদি গ্রুপ হায়াত তাহরির আল-শাম ( এইচটিএস, যাদের আগে বলা হতো আল-নুসরা ফ্রন্ট)। এদের তুরস্ক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে।

কিন্তু এদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাতে আবার তুরস্কের ১২টি পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি রয়েছে, এবং এদের সাথে প্রচ্ছন্ন সমঝোতার ভিত্তিতেই এগুলো স্থাপিত হয়েছে ।

এইচটিএস ইদলিবের ৬০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

এর বিপরীতে আবার জিহাদিদের মোকাবিলার জন্য গঠিত একটি বাহিনী ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএলএফকেও সমর্থন দেয় তুরস্ক।

ন্যাশনাল আর্মি নামে আরেকটি বিদ্রোহী গ্রুপকেও তুরস্ক সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের অস্ত্র দেয়।

তুরস্ক সিরিয়া ইদলিব
জাতিসংঘ বলছে ইদলিবে যুদ্ধ হলে আট লক্ষ লোক গৃহহীন হবে।

অভিযান শুরু হলে ইদলিবে তুরস্কের সমর্থিত সব বাহিনীই আক্রান্ত হবে।

বিবিসির সংবাদদাতা গুনেই ইলদিজ জানাচ্ছেন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তেহরানের বৈঠকে প্রস্তাব করেন যে হয় অভিযান স্থগিত করা হোক, অথবা শুধু এইচটিএসের অবস্থানগুলোর ওপর আক্রমণ সীমিত রাখা হোক।

তুরস্কের জন্য বিপদ হলো – ইদলিব পুনর্দখলের অভিযান শুরু হলে এসব প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ তা মোকাবিলা করার জন্য একজোট হয়ে যেতে পারে।

ইদলিবের স্থিতাবস্থা এখন ভেঙে যাবার মুখে

তুরস্কের একটি সূত্র বলেছে, ইদলিবে অভিযান হলে সেখান থেকে পালানো লোকদের তুরস্ক তার ভুখন্ডে ঢুকতে না দিয়ে তাদের আফরিনে আশ্রয় দেবার চেষ্টা করতে পারে – যাতে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ আফরিনে সুন্নি আরব বিদ্রোহী ও বেসামরিক লোকদের সংখ্যা বাড়িয়ে জনসংখ্যার অনুপাত বদলে দেয়া যায়।

তুরস্কের আরো একটা দুশ্চিন্তা হলো : ইদলিবে যুদ্ধ শুরু হলে কুর্দী ওয়াইপিজি বাহিনী কি করে তা নিয়ে।

হযতো তারা আফরিন মুক্ত করার জন্য আরেকটি যুদ্ধ শুরু করে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনাও আছে।

তাই ইদলিবের যুদ্ধ যে দিকেই যাক – তা গত দু’বছর ধরে চলা স্থিতাবস্থা ভেঙে দিতে পারে – এবং তুরস্কের জন্য সৃষ্টি করতে পারে নতুন একাধিক সমস্যা ।