আসছে না নতুন অ্যান্টিবায়োটিক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক (জীবাণুনাশক) লেখার অভিযোগ করেন অনেক চিকিৎসকই। এক চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রে ভুল অ্যান্টিবায়োটিক চিহ্নিত করেন অন্য চিকিৎসক, লিখে দেন আরেকটি অ্যান্টিবায়োটিক। এ কারণেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে অনেক ব্যাকটেরিয়া, যার ফলে অনেক রোগের নিরাময় হয়ে পড়ছে অসম্ভব। হরেক রকমের অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের গছিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে ওষুধ কম্পানিগুলো। তাদের প্রতিনিধিদের জটলা বাড়ছে চিকিৎসকদের চেম্বারে।

ওষুধবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, গত দুই দশকে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়নি। পুরনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে দ্রুত। খুব শিগগির নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়ে সর্বরোগের মহৌষধ হবে এমন সম্ভাবনা নেই। এ জন্য গবেষণা যাঁদের করার কথা, তাঁরাই পথ হাতড়াচ্ছে। এ মুহূর্তে একমাত্র উপায় হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। যুক্তরাষ্ট্রে এমআরএসএ ব্যাকটেরিয়া নিরোধে সমস্যা হচ্ছে। সিআরই (কার্বাপেনেম-রেসিস্ট্যান্ট এন্টেরোব্যাকটেরিয়াসি), সি ডিফিসাইলও (ক্লোস্ট্রিডিয়াম ডিফিসাইল) অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে। কঠিন হয়ে পড়ছে গনোরিয়ার চিকিৎসাও।

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ও বেচাকেনা বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ আছে কি না-জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘এত দিন আমরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সচেতন করার ওপরই বেশি জোর দিয়েছিলাম। বিশেষ করে প্রেসক্রিপশন ছাড়া যাতে কেউ ওষুধ না কেনে, না বিক্রি করে এবং পরিপূর্ণ ডোজ যাতে রোগীরা প্রয়োগ করে, সে জন্য ফার্মেসিতে আমরা পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। হাসপাতালেও আমরা এসব বিষয়ে নানা প্রচারণা চালিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মানুষ এখন বিষয়টি জানলেও তা প্রতিপালন করে না, অনেকটাই উদাসীন থাকে। এ জন্য প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বেচাকেনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করার বিধান প্রস্তাবিত নতুন ওষুধ আইনের খসড়ায় সংযুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এটি মনিটরিংয়ের জন্য আলাদা জনবল রাখার প্রস্তাবও রয়েছে। কারণ আমরা দেখেছি, মানুষ যখন জেনেশুনেও নির্দেশনা মানছে না, তখন তাদের শাস্তির আওতায় আনা ছাড়া কাজ হবে না।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘শুধু বিক্রেতা বা ক্রেতারাই যথেচ্ছ বিক্রি বা ক্রয় করছে না, চিকিৎসকদের মধ্যেও অনেকে সঠিকভাবে প্রেসক্রিপশন করেন না, অনেকে অপ্রয়োজনেও একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। আমরা এটিও বন্ধ করতে চাই চিকিৎসকদের সচেতনতার মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোশিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ডাক্তারদের মধ্যে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক লেখার প্রবণতা খুব একটা আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ ডাক্তাররা এ ব্যাপারে সচেতন আছেন। বরং এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বেচাকেনার সুযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া। তবেই অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমে আসবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ভয়ংকর ১০ ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যারা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ফুসফুস ও মূত্রনালির সংক্রমণ, মেনিনজাইটিস, যক্ষ্মা, গলা ও চামড়ার রোগ, এইডস ও ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তীব্রতার দিক থেকে দুটি ব্যাকটেরিয়া মারাত্মক, দুটি ভয়ংকর এবং ছয়টি উদ্বেগজনক। আর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতার বিচারে দুটি উচ্চ, পাঁচটি মধ্যম, তিনটি এখনো নিম্ন মাত্রার। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত অনেক বৃদ্ধ ও মধ্যবয়সী রোগী কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই আরোগ্য লাভ করছে না। বেশির ভাগ ই কোলি ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর না হলেও খাদ্যের বিষক্রিয়া বা মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ ঘটায় এমন কিছু ই কোলি এখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ডায়ারিয়ার জন্য দায়ী সি ডিফিসাইল তো বিশ্বের সব হাসপাতালেই বিরাজ করছে ছারপোকার মতো।

ক্রমেই জটিল হতে থাকা এই বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাজ্যের লংগিচিউড প্রাইজ। তাদের গবেষণায় বলা হয়েছে, ওই ১০টি ব্যাকটেরিয়া শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে না, আধুনিক বিজ্ঞানের জন্যও বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার খুব ধীরগতির এবং জটিল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ছে, সাধারণ অনেক সংক্রমণের নিরাময়ও অসম্ভব হয়ে পড়ছে, যা ভয়ংকর হুমকি। এখন জরুরি হচ্ছে প্রতিরোধব্যবস্থা। না হলে যক্ষ্মা, গনোরিয়া, নিউমোনিয়ার নিরাময়ও কঠিন হয়ে পড়বে, যা এত দিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচিত ছিল।

অ্যান্টিবায়োটিকের দিন তাহলে ফুরিয়ে যাচ্ছে কি না—মেডলাইনপ্লাস সাময়িকীর এমন প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের এনআইএআইডির পরিচালক ফসি বলেছেন, ‘কিভাবে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির চেষ্টা করছি, ওষুধ কম্পানিগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে কাজ করছি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের মতে, গবেষণা যাদের করার কথা সেই দেশগুলোই যখন পথ হাতড়াচ্ছে, তখন বাংলাদেশের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণের পথই আপাতত খোলা।

অ্যান্টিবায়োটিক লেখার জন্য চিকিৎসকদের প্রভাবিত করার বিষয়ে অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান  বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এটা স্বাভাবিক বিপণন কৌশল। চাহিদা থাকলে তা উৎপাদন ও বাজারজাত করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার দিকে তো নজর রাখতেই হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের বেচাকেনা বন্ধ করা। তবেই অনেক অনিয়মের পথ বন্ধ হয়ে যাবে, যথেচ্ছ ব্যবহারও কমে যাবে।

তবে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় যেসব অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয় না, বাংলাদেশে অনেক সময় তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ হলো দূষণ। নিয়মমাফিক ওষুধে যখন সর্দি-কাশি-জ্বর সারতে চায় না, ডাক্তাররা তখন ঝুঁকি না নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন।

তবে দরকার ছাড়াও যে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে থাকেন, সে অভিযোগও মিথ্যা নয়। ওষুধের দোকানের মালিক বা বিক্রয়কর্মীরাও রোগীদের হাতে খুচরা অ্যান্টিবায়োটিক তুলে দেয়। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে এবং মানুষকেও সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।