আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয়ের মূলনীতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আল্লাহর রাস্তায় সঠিক পদ্ধতিতে দান করলে তা কখনো বৃথা যাবে না। বরং মহান আল্লাহ তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে সেই বান্দাকেই ফেরত দেবেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছে : যেমন একটি শস্যবীজ বপন করা হয় এবং তা থেকে সাতটি শীষ উৎপন্ন হয়, যার প্রতিটি শীষে থাকে ১০০টি করে শস্যকণা। এভাবে আল্লাহ যাকে চান, তার কাজে প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মুক্তহস্ত ও সর্বজ্ঞ। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬১)

প্রতিটি মুসলমানের মহান আল্লাহর রাস্তায় দান করার সঠিক পদ্ধতি ও শর্তগুলো জেনে রাখা আবশ্যক। নিম্নে এই নীতিমালা তুলে ধরা হলো—

 

নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা

দান হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান-খয়রাত করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭২)

দান-খয়রাত করার সময় এ বিষয়ে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। দান-খয়রাত করতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কারো মনে যদি অন্য কিছু চলে আসে, মানুষ দেখানো উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেই দান কোনো কাজে আসবে না।

 

প্রভাব বিস্তার না করা

আমরা অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে কোনো উপকার করলে তার ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করি। আমি তার অমুক উপকার করেছি। এখন সে আমার কথা শুনতে বাধ্য—এমন মনোভাব রাখা যাবে না।

ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং ব্যয় করার পর নিজেদের অনুগ্রহের কথা বলে বেড়ায় না আর কাউকে কষ্টও দেয় না, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের কাছে এবং তাদের কোনো দুঃখ, মর্মবেদনা ও ভয় নেই।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬২)

অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে যে কারো ওপর প্রভাব খাটায় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, খোঁটা দেয় না, মহান আল্লাহ নিজ হাতে তাদের প্রতিদান দেবেন। তাদের প্রতিদান নষ্ট হওয়ার কোনো ভয় নেই এবং তারা নিজেদের এই অর্থ ব্যয়ের কারণে লজ্জিত হবে—এমন ধরনের কোনো অবস্থারও সৃষ্টি হবে না।

 

আল্লাহর পথে উত্তম জিনিস ব্যয় করা

আমরা অনেক সময় রাস্তাঘাটে কোনো ভিক্ষুককে দান করার সময় বেছে ছেঁড়া টাকাটা দিই। জামাকাপড় দেওয়ার সময় পুরনো ও ব্যবহারের অযোগ্যগুলো দিই। খাবার নষ্ট হয়ে গেলে তারপর গরিবদের দিই। এটা উচিত নয়।

কারণ আমরা যদি এখন দান করার সময় বেছে বেছে খারাপটা দিই, তাহলে আল্লাহ যখন আমাদের প্রতিদান দেবেন তখন প্রতিদানের মানও তেমনই হবে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যা কিছু আমি জমিন থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উত্কৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো। তাঁর পথে ব্যয় করার জন্য তোমরা সবচেয়ে খারাপ জিনিস বাছাই করার চেষ্টা কোরো না; অথচ ওই জিনিসই যদি কেউ তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা কখনো তা নিতে রাজি হও না, যদি না তা নেওয়ার ব্যাপারে তোমরা চোখ বন্ধ করে থাকো। তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন এবং তিনি সর্বোত্তম গুণে গুণান্বিত।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৭)

 

গোপনে দান করা

বান্দা আল্লাহর রাস্তায় গোপনে দান করলে আল্লাহ তা বেশি পছন্দ করেন। যদিও অন্যদের দান-সদকায় উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যেও দান করা যায়। তবে গোপনে করার মধ্যে বেশি তাকওয়া পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমাদের দান-সাদকাগুলো প্রকাশ্যে করো, তাহলে তা-ও ভালো, তবে যদি গোপনে অভাবীদের দাও, তাহলে তোমাদের জন্য এটিই বেশি ভালো। এভাবে তোমাদের অনেক গুনাহ নির্মূল হয়ে যায়। আর তোমরা যা কিছু করে থাকো, আল্লাহ অবশ্য তা জানেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭১)। তাই নিজেদের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সর্বদা গোপনে দান করা উত্তম।

 

 

ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী দান করা

কারণ, তারা সেই টাকা অহেতুক কাজে খরচ করবে। কখনো কখনো গুনাহর কাজেও খরচ করতে পারে। যেমন রাস্তায় কখনো কখনো এমন লোকও পাওয়া যায় যে সে ক্ষুধার্ত। তাকে প্রয়োজনমতো টাকা দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তাকে যদি বেশি টাকা দেওয়া হয়, তাহলে সে তা দিয়ে মাদক সেবনে বসতে পারে। এমন লোকদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত দান করা উচিত নয়।

যেহেতু প্রতিটি মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাই এ ধরনের লোকের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।

 

সুযোগ থাকলে ঋণগ্রস্তকে ক্ষমা করা

কাউকে ঋণ দিলে, সে যদি যৌক্তিক কারণে তা দিতে অক্ষম হয়, তাহলে আমাদের উচিত তাকে সময় দেওয়া। সম্ভব হলে গোটা ঋণ মাফ করে দেওয়া। মহান আল্লাহ এ ধরনের সদকাকে খুব বেশি ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের ঋণগ্রহীতা অভাবী হলে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি সদকা করে দাও, তাহলে এটা তোমাদের জন্য বেশি ভালো হবে, যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)

 

তবে ইচ্ছাকৃত কোনো পাওনাদারকে মিথ্যা বলা, টাকা পরিশোধে বিলম্ব করা জঘন্য অপরাধ। যারা এভাবে মানুষকে ঠকাবে, আল্লাহ তাদের কঠিন শাস্তি দেবেন।

 

কাদের জন্য খরচ করবেন

আমাদের দায়িত্ববোধ থেকেই অনেক খরচ করতে হয়। তবে সেই খরচে কাকে প্রাধান্য দেব, সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, লোকেরা জিজ্ঞেস করছে, আমরা কী ব্যয় করব? জবাব দাও, যে অর্থই তোমরা ব্যয় করো না কেন, তা নিজেদের মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় কোরো। আর যে সৎকাজই তোমরা করবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ অবগত হবেন। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৫)

উল্লেখ্য, ফরজ সদকা তথা জাকাত ইত্যাদির কথা বলা হচ্ছে না। কারণ পিতা, মাতা, স্ত্রী-সন্তানদের জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে না। এর বাইরে আমরা আমাদের পরিবার-আত্মীয়-স্বজনের জন্য দায়িত্ব হিসেবেও যা কিছু খরচ করি, মহান আল্লাহ তার বিনিময়ে আমাদের সদকার সওয়াব দেন।

 

আল্লাহর পথে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যয়

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আমরা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করব? বলে দাও, যা কিছু তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৯)। নিজের পরিবারের জন্য খরচ করার পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা দান করতে বলা হয়েছে। এমনভাবে দান করা যাবে না যে নিজের পরিবারকে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সেই বান্দাদের সুনাম করেছেন, যারা দান-সদকা করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না বরং উভয় প্রান্তিকের মাঝামাঝি তাদের ব্যয় ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৭)

তাই খরচ করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এত বেপরোয়া খরচ করা যাবে না, পরে নিজেই মানুষের কাছে হাত পাততে হয়। আবার এত কৃপণতাও করা যাবে না, যার জন্য সব মহলে নিন্দিত হতে হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিজের (দানের) হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৯)