আল্লাহর কুদরত জমজম কূপ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

হজ বা ওমরাহ পালনে যারা পবিত্র মক্কা নগরীতে হাজির হন তাদের কাছে জমজম কূপের আকর্ষণ অতুলনীয়। অনেকে হজ বা ওমরাহ উপলক্ষে মক্কায় অবস্থানকালে পুরোটা সময় এই পবিত্র কূপের পানি পানের বাসনা মনে পোষণ করেন। হাজিরা দেশে ফেরার সময় প্রায় সবাই জমজমের পানি নিয়ে আসেন স্বজনদের জন্য। আরবের রুক্ষ মরুপ্রান্তরে সাড়ে ৪ হাজার বছর ধরে রয়েছে জমজম কূপের অস্তিত্ব। পবিত্র জমজম নিয়ে রসুল (সা.)-এর বহু হাদিস রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হলো জমজমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তির খাদ্য এবং ব্যাধির আরোগ্য।’ (আল মুজামুল আউসাত) এ কূপের কথা রয়েছে আল কোরআন ও বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাত কিতাবেও।

হজরত ইবরাহিম (আ.) সন্তানের বাবা হন ৮৬ বছর বয়সে। স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম নেয় চাঁদের আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে এক পুত্রসন্তান, নাম তার ইসমাইল। কিন্তু আল্লাহ ইবরাহিমকে নির্দেশ দেন ও হাজেরা ও ইসমাইলকে জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে নির্বাসনে দিয়ে আসার। তাওরাতে বলা হয়েছে, প্রথম স্ত্রী সারার দাবি অনুযায়ী ইবরাহিম হাজেরা ও ইসমাইলকে নির্বাসনে দেন। সারার দাবিতে ইবরাহিম (আ.) কষ্ট পেলেও আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে মন খারাপ না করার জন্য বলেন। আল্লাহর হুকুম পালনে ইবরাহিম (আ.) হাজেরা ও শিশু পুত্র ইসমাইলকে নির্বাসন দিতে নিয়ে এলেন ধু-ধু মরীচিকাময় আরবের একটি উপত্যকায়। যেখানে কেউ বসবাস করত না। শাম বা ফিলিস্তিন থেকে ইয়েমেন যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলা ছাড়া কেউ তাঁবু স্থাপন করত না। বছরের বেশির ভাগ সময়ই জনবসতিহীন এ এলাকাটি এমন বিরান হয়ে থাকত যে কোনো পাখির দেখাও মিলত না। এই নিদারুণ পরিস্থিতিতে হজরত ইবরাহিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কিন্তু এইকঠিন বিপদেও তিনি আস্থা রাখেন মহান আল্লাহর ওপর। তিনি তাঁর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত পশুর লাগাম ধরে সজল চোখে স্ত্রী ও প্রিয় পুত্রের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু! এ স্থানকে নিরাপদ শহর ও জনপদে পরিণত কর। এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে তাদের বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাদ্য রিজিক হিসেবে প্রদান কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১২৬)

হজরত ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী-পুত্রকে নির্বাসনে রেখে চলে যাওয়ার পর একসময় হজরত হাজেরা (আ.)-এর খাদ্য ও পানি শেষ হয়ে যায়। অনাহারে শুকিয়ে যায় হাজেরা (আ.)-এর বুকের দুধ। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় হজরত ইসমাইল (আ.) কাতর হয়ে পড়লেন। তাঁর কান্নায় মা হাজেরা (আ.) হয়ে পড়লেন দিশাহারা। পানির খোঁজে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করেন। সাফা পাহাড়ের মরীচিকাকে পানির নহর ভেবে দৌড়ে গেলেন। দেখলেন সেটি তপ্ত বালুপ্রান্তর। সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ে তাকিয়ে ভাবলেন, সেখানে বইছে স্বচ্ছ পানির ধারা। দৌড়ে সেখানে গিয়েও হাজেরা (আ.) মরীচিকা ছাড়া কিছু পেলেন না। প্রিয় সন্তানের তৃষ্ণা মেটাতে পানির আশায় সাফা থেকে মারওয়া ও মারওয়া থেকে সাফা পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। অবশেষে মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত মা হাজেরা (আ.) দেখতে পেলেন শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের তলদেশ থেকে বইছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। যা পরবর্তী সময় জমজম কূপ নামে পরিচিতি লাভ করে।

কাবা শরিফ থেকে ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট পশ্চিমে মাসজিদুল হারামের ভিতরে এ পবিত্র কূপের অবস্থান। প্রায় ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট চওড়া একটি আয়ত ক্ষেত্রের মতো কূপটি। যার গভীরতা ৩০ মিটার বা ৯৮ ফুট। আরবের মরুপ্রান্তরে যেখানে বৃষ্টিপাত নগণ্য সেখানে সাড়ে ৪ হাজার বছর ধরে এ কূপটি লাখ লাখ মানুষের জন্য পানি সরবরাহ করছে। জমজম কূপের নামকরণ নিয়ে নানা মত রয়েছে। হিব্রু ভাষায় ‘জমজম’ অর্থ ‘থাম থাম’। মা হাজেরা (আ.) পানির প্রবাহ রোধ করার জন্য বাঁধ নির্মাণের সময় বলেছিলেন, ‘জম জম’ অর্থাৎ থাম থাম। এ কূপের অলৌকিকতা যে কারোর উপলব্ধিতে আসার কথা। সৌদি আরবের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বোর্ডের অধীনে জমজম কূপের ওপর একটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, জমজমের পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০.৬ ফুট নিচে। প্রতি সেকেন্ডে ক্রমাগত ৮ হাজার লিটার হারে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পাম্প করা হয়। তখন পানির স্তর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়। কিন্তু যখন পাম্প করা বন্ধ করা হয়, তখন পানির স্তর মাত্র ১১ মিনিটে আবার ১৩ ফুট উচ্চতায় ফিরে আসে। প্রতি সেকেন্ডে ৮ হাজার লিটার মানে প্রতি মিনিটে ৪ লাখ ৮০ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করা হয় জমজম কূপ থেকে। সে হিসাবে প্রতি ঘণ্টায় ২৮.৮ মিলিয়ন লিটার এবং প্রতিদিন ৬৯১.২ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করা হয়। যা আল্লাহর কুদরতের একটি বড় নিদর্শন।

লেখক : সভাপতি, আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন