আর্থিক মন্দা মোকাবেলায় আধুনিক মুদ্রানীতির প্রয়োগ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

অর্থনৈতিক মন্দা মোটেই নতুন কিছু নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মন্দাও একটি নিয়মিত ঘটনা। বিশেষ করে মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত পশ্চিমা বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নতি ও মন্দা পাশাপাশি বিরাজ করে এবং নিয়মিত বিরতি দিয়ে পর্যায়ক্রমে দেখা দেয়। সেই ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় থেকে প্রতি ৮-১০ বছর পর পর এই মন্দা দেখা দিয়েছে। নিকট অতীতের ২০০৮ সালে আমেরিকার সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির কারণে আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে এক ভয়ংকর অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল।

সেই থেকে দেড় যুগ পার হয়ে গেলেও সেভাবে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়নি। করোনা মহামারির প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সেভাবে মন্দা দেখা দেয়নি সরকারের ব্যাপক অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কারণে। সেই বিবেচনায় উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন এবং বলা যায় শুরুও হয়ে গেছে। অতীতের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ ছিল মূলত অর্থনীতির দুর্বলতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, যার কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। এ রকম অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে এবং মন্দা কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

২০০৮ সালের মন্দার কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমেরিকার মুদ্রাবাজারে আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অতিমুনাফার লোভে সেখানকার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ হাইব্রিড সেবা গ্রাহকদের মধ্যে বিক্রি করে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। এর ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে ভয়ংকর মন্দা নেমে আসে, যা দ্রুতই উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু এই মন্দার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তাই এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এলেও এই মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংকগুলো সেভাবে এগিয়ে আসতে পারেনি। উল্টো সরকারকে বেইল আউট প্যাকেজের নামে পর্যাপ্ত অর্থ ঢালতে হয়েছে এই আর্থিক খাত উদ্ধারের জন্য।

উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে অর্থনৈতিক মন্দা উন্নত বিশ্বের মন্দার মতো সেভাবে কখনোই আসে না। এর কারণ উন্নত বিশ্বের অর্থনীতি পূর্ণ স্কেলে রান করে, সেখানে আমাদের দেশের অর্থনীতি পূর্ণ স্কেল তো দূরের কথা, এখনো যথেষ্ট আন্ডার স্কেলে রান করছে। অর্থনীতির পূর্ণ স্কেল এমন একটি অবস্থা, যেখানে অর্থনীতির সূত্রগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজ করে। অর্থাৎ দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ চরম সীমায় পৌঁছে যায় এবং কর্মসংস্থানও সর্বোচ্চ অবস্থানে বিরাজ করে। অর্থনীতির এমন অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের সুযোগ যেমন থাকে না, তেমনি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও প্রয়োজন পড়ে না। এ রকম পরিস্থিতিতে অর্থনীতির কোনো একটি বিষয়ে সামান্য ঝাঁকুনিতেই মন্দা নেমে আসে। পক্ষান্তরে ইমার্জিং মার্কেট বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সুযোগ থাকে এবং যথেষ্ট নতুন কর্মসংস্থানের প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া এসব দেশের অর্থনীতির মৌলিক উপাদানগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব কারণেই উন্নয়নশীল বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা কখনোই সেভাবে দেখা দেয় না এবং দেখা দিলেও তা কখন কিভাবে আসে আর চলে যায়, তা সেভাবে বোঝা যায় না। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে মন্দাটা সেভাবে বোঝা না গেলেও এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অর্থাৎ বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে অর্থনীতি বেশ ভালোই ধাক্কা খায়। তবে সে ধাক্কা নিজস্ব শক্তিতেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। এখন যেহেতু দেশের অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে, তাই বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই লাগে।

নিকট অতীতের অর্থনৈতিক মন্দার তুলনায় এবারের মন্দার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অতীতের সব মন্দার পেছনে ছিল অর্থনৈতিক কারণ। পক্ষান্তরে এবারের মন্দার পেছনে আছে রাজনৈতিক কারণ। করোনা মহামারির ধাক্কা সামাল দিতে পারলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা উন্নত বিশ্ব মোটেই সামলে উঠতে পারেনি। উল্টো রাশিয়া-ইউক্রেনের কনভেনশনাল যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করতে গিয়ে এক ধরনের লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে সমগ্র বিশ্বকে। এখন উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশকেই এই মন্দা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেহেতু এবারের মন্দার কারণ ভিন্ন, তাই অর্থনীতির স্বাভাবিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে এই মন্দা মোকাবেলা করা বেশ কঠিন এবং সে কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব আধুনিক মুদ্রানীতি (মডার্ন মানিটারি থিওরি) প্রয়োগ করে এই মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্ব এই আধুনিক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করা তো দূরের কথা, তারা অর্থনীতির এই নতুন তত্ত্ব বুঝে ওঠার চেষ্টাও করছে বলে মনে হয় না।

এই আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডায় খুবই আলোচিত বিষয়। এখানকার প্রখ্যাত কিছু অর্থনীতিবিদ এই থিওরির প্রবক্তা। আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরি একেবারে নতুন কোনো অর্থনীতির সূত্র বা তত্ত্ব নয়। এটি মূলত কেইনসিয়ান থিওরির একটু ভিন্ন বা পরিবর্তিত রূপ। ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় অর্থনীতিবিদ কেইনস (জন মেনারড কেইনস) এক নতুন মুদ্রানীতির আবিষ্কার করেছিলেন, যা প্রয়োগ করে পশ্চিমা বিশ্ব সেই মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। সেই কেইনসিয়ান থিওরির মূলকথা ছিল যে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং এ ক্রয়ক্ষমতাই দেশের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করবে। এই বর্ধিত চাহিদা মেটাতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। ফলে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, যা পুনরায় সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করবে এবং এভাবেই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে ঘাটতি বাজেটে যেতে হয় এবং ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। সুতরাং কেইনসিয়ান থিওরির মূলকথা হচ্ছে, সরকার পর্যাপ্ত ঋণ নিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখবে বা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেবে। পক্ষান্তরে আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরির প্রবক্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বর্ধিত কর আদায় বা ঋণ গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদের জোরালো বক্তব্য হচ্ছে, সরকারি কোষাগার থেকে প্রয়োজনীয় মুদ্রা ছাপিয়েই জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি বা ধরে রাখতে হবে।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকেই এই মডার্ন মনিটারি থিওরি আলোচনায় আসে এবং এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সমালোচনা থাকায় উন্নত দেশগুলো এই নতুন মুদ্রানীতি সেভাবে গ্রহণ করার সাহস দেখায়নি। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ভয়ংকর আর্থিক সংকট দেখা দিলে এসব উন্নত বিশ্বের সরকার এক কঠিন সমস্যায় পড়ে এবং কিছুটা বাধ্য হয়েই এই আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরি প্রয়োগ করে জনগণের মধ্যে দেদার অর্থ বিলাতে থাকে। ফলে করোনার প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট তো সফলভাবে মোকাবেলা করেছেই, সেই সঙ্গে অর্থনীতির চাকাও সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। এখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় এই আধুনিক মুদ্রানীতি খুব ভালোভাবেই প্রয়োগ করছে; যে কারণে তারা সুদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি করে জনগণের ওপর আর্থিক খরচের বোঝা চাপিয়ে দিলেও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ব্যক্তিগত ঋণের সরবরাহ অবারিত করে রেখেছে। জনগণের ক্রেডিট কার্ড এবং ব্যক্তিগত ঋণের কোনো কমতি নেই। ফলে দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে তেমন হা-হুতাশ লক্ষ করা যায় না। কারণ মানুষের হাতে খরচ করার মতো অর্থ আছে, হোক না তা ঋণের টাকা।

আমাদের দেশে বর্তমান যে আর্থিক সংকট বা মন্দা তারও কারণ একই; অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বের ভুল রাজনীতি। সে কারণে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বের মতো আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরি প্রয়োগ করে। তবে আমাদের দেশে এই থিওরি হুবহু প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে বড় অসুবিধা হলো আমাদের মুদ্রা অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় হারের ওপর নির্ভরশীল, যা উন্নত বিশ্বের মুদ্রার বেলায় ঘটে না। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বর্তমান আর্থিক সংকটের কারণে আমাদের দেশে দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে এবং অবস্থা সবচেয়ে খারাপ আকার ধারণ করেছে জ্বালানি তেলের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। এ কারণেই আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আধুনিক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এটি যে শুধু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা, তা মোটেই নয়। এই কথাটি একজন আধুনিক মুদ্রানীতি বিশেষজ্ঞ বাঙালি অর্থনীতিবিদ অনেক আগেই বলেছিলেন। করোনা মহামারি শুরুর দিকে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ এবং আমেরিকার (এমআইটির) অর্থনীতির অধ্যাপক ড. অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকট মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশের সরকারকে টাকা ছাপিয়ে জনগণের হাতে দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ধরে রেখে এই সংকট মোকাবেলা করার জন্য জোরালো সুপারিশ করেছিলেন। তখন সেটি প্রয়োগ করা না হলেও বর্তমান আর্থিক সংকট মোকাবেলায় এই আধুনিক মুদ্রানীতি বা মডার্ন মনিটারি থিওরি প্রয়োগ করার সময় কি এসেছে?

অর্থনীতির আধুনিক এই থিওরি কিভাবে কাজ করবে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com

 

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ