আর্থিক খাতে আসছে সাত সংস্কার

কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান নিয়মনীতি সহজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আরও সহজ করা হবে ‘ফরেন কারেন্ট অ্যাকাউন্ট (এফসিএ)’ খোলার পদ্ধতি। ‘দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট’ সংস্কারের মাধ্যমে এটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে ‘কোভিড-১৯ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিকরণের’ লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সভায় উল্লিখিত দুটিসহ সাতটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরও জানা গেছে, ওই বৈঠকে নেয়া বাকি পাঁচটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও লভ্যাংশ সহজে নিজ দেশে নিতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি আরও সহজ করা। আর এ দুটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান আইন-বিধিবিধান কী ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করা যায়-এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাব শিগগির পাঠাতে বলা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে।

পাশাপাশি ‘ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’-এর আওতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সেবা দেয়ার বিষয়টি ‘টাইম বাউন্ড’ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়, প্রতিযোগী দেশগুলোর বিষয় বিবেচনায় রেখে ব্যাংকিং খাতের সেবা সহজ করে এ সংক্রান্ত সময়োপযোগী নির্দেশনা জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে তদারকিও করবে। সর্বশেষ সিদ্ধান্তে বলা হয়, দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৭৪-কে (২০১৫ সালে সংশোধিত) বাংলা ভাষায় রূপান্তর এবং সময়োপযোগী করার জন্য আইনের খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে। এই মতামত দ্রুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে পাঠানোর কথা বলা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে আগামীতে ডাবল ডিজিটে প্রবৃদ্ধি নিতে হলে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু বর্তমান এই হার ৩১ দশমিক ৬ শতাংশে আছে। জাতীয় সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত ৩০ শতাংশের কম। আর সঞ্চয়ের বিদ্যমান হার শিগগির বাড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে বিনিয়োগের হার বাড়াতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও লভ্যাংশ প্রত্যাবাসন সহজকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগের যে ঝুঁকি আছে, সেটি আগে কমিয়ে আনতে হবে। ইজি অব ডুয়িং বিজনেস-এর পরিবেশ আরও বেশি উন্নত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছতে হবে-বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা আগের তুলনায় সহজ, কঠিন নয়। এ ছাড়া অবকাঠামো ঘাটতি পূরণ করতে হবে।

বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যোগাযোগে কিছুটা উন্নত হলেও বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইন, রেগুলেশন, নিয়মনীতি খুব বেশি সংস্কার করা হয়নি। দেশে লজিস্টিক দুর্বলতা আছে। সেটি কাটাতে হবে। এ ছাড়া কর পরিশোধের ক্ষেত্র আরও সহজ, স্বচ্ছ করা, অন্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে বিনিয়োগের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে বিনিয়োগের প্রতিযোগী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বের যে কোনো দেশের বিনিয়োগ এখানে আসবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি নির্দেশ দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং তাদের বিনিয়োগের অর্থ বা লভ্যাংশ নির্বিঘ্নে নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ বৈঠক করেছে। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, কোভিড-১৯ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। শুরু হয়েছে নতুন অর্থনৈতিক মেরুকরণ এবং বিনিয়োগের বহুমুখীকরণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে চীন থেকে অনেক বিনিয়োগ অন্যত্র স্থানান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশ ভারত, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া এ ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন, বিধি, বিধান, কর ব্যবস্থা ও ব্যাংকিং পদ্ধতি সহজ করেছে।

সেখানে আরও বলা হয়, দেশের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থাসহ এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস-এর আলোকে বিদ্যমান ব্যাংক পরিষেবা কীভাবে সহজ করা যায় পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের আইনি কাঠামো, নীতিসহায়তা, ব্যাংকিং নিয়মনীতি ও পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহারসহ ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে।

ওই বৈঠকে আর বলা হয়, ‘দ্য ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৭৪ বাংলা ভাষায় রূপান্তর এবং সময়োপযোগীর কার্যক্রম চলছে। সে লক্ষ্যে খসড়া আইনের ওপর মতামত চাওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। তবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’ দি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৮১, অর্থঋণ আদালত-২০০৩ সময়োপযোগী, ভাষান্তর ও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ পেতে অনেক সময় লাগছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের ঋণ সংক্রান্ত বৈঠক মাসে একবার করছে। এটি আরও বাড়ানো দরকার বলে বৈঠকে মতামত দেয়া হয়। পাশাপাশি বিদেশি ঋণের সঙ্গে ওয়ার্কিং কেপিটাল দেয়া যায় কি না, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়।

সূত্র আরও জানায়, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বৈঠকে ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট খোলা সহজীকরণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান প্রজ্ঞাপনগুলো আরও সহজ করা, বিদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে সেমিনার এবং ওয়েবেনার আয়োজন, কর্পোরেট ঋণ, স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার ওপর গুরত্বারোপ করা হয়।

 

সুত্রঃ যুগান্তর