আমি প্রস্তুত, নির্বাচকদের ডাকের অপেক্ষায়: মিজানুর রহমান

আব্দুল্লাহ আল মারুফ


ঘোষণা করা হয়েছে জিম্বাবুয়ে সফরের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। টেষ্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটের জন্য আলাদা আলাদা অধিনায়ক করে ঘোষিত দলে একমাত্র নতুন মুখ শামীম পাটোয়ারি। তিন বছর পর দলে ফিরেছেন নুরুল হাসান সোহান। শামীম পারলেও নির্বাচকদের মন গলাতে পারেননি এবারের বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লীগের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান এবং গ্রুপ পর্বের ১১ রাউন্ড শেষে সর্বোচ্চ রান (৪১৮) সংগ্রাহক, ব্রাদার্স ইউনিয়নের অধিনায়ক মিজানুর রহমান।
জিম্বাবুয়ে সফরে বাংলাদেশ দল এবং এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে নিজের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যেরে পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রাজশাহীর এই তারকা ব্যাটসম্যান (মিজানুর রহমান)।
তার সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো;
প্রশ্ন: কেমন আছেন? ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান আপনার, কেমন লাগছে?
মিজানুর রহমান: আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে অনেক ভাল আছি। নাম্বার ওয়ান পজিশন সব সময় সবার কাছেই ভালো লাগে, আমিও এর বাইরে না। আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো লাগছে।
প্রশ্ন: এবারের প্রিমিয়ার লীগের প্রথম সেঞ্চুরিটি এসেছে আপনার ব্যাট থেকে। এটি টি-টোয়েন্টিতে আপনার প্রথম সেঞ্চুরি। কেমন লাগছে ভাবতে?
মিজানুর রহমান: অবশ্যই অনেক ভালো লাগছে। টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করা একটু ডিফিকাল্ট। এটা আসলে একটা ভাগ্যেরও বিষয়। দেখবেন ভাগ্যের পরশ ছাড়া সচরাচর সেঞ্চুরি হয় না টি-টোয়েন্টিতে।
প্রশ্ন: এর আগেও প্রথম শ্রেণী ও লিস্ট-এ মিলিয়ে আপনার ১৫ টি সেঞ্চুরি আছে। সেগুলোর থেকে এই সেঞ্চুরিটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মিজানুর রহমান: চারদিনের ম্যাচে বা ৫০ ওভারের ম্যাচে সেঞ্চুরি করার জন্য অনেক সুুযোগ থাকে। সময় নিয়ে সবকিছু করা যায়। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে সে সুযোগ নেই। এদিক থেকে এবারের সেঞ্চুরিটি একটু বিশেষ বটে, তবে অন্যগুলোর চেয়ে এগিয়ে রাখতে চাইনা।
প্রশ্ন: আপনার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এর আগে ২২ ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ৩২৫ রান, আর এবার ১০ ইনিংসেই করলেন ৪১৮! হঠাৎ এই অভাবনীয় উন্নতির রহস্য কি?
মিজানুর রহমান: আমি বলব এটা আল্লাহ্ পাকের অশেষ রহমত এবং আমার পরিশ্রম ও চেষ্টা। লকডাউনের সময় আমি ১৮ মাস খেলা ছাড়া ছিলাম সত্যি, কিন্তু প্র্যাকটিসে কখনো কমতি হতে দেইনি। যখন যা করেছি, মন দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আর ভেবেছি, যখনই খেলার সুযোগ পাবো, আমার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করবো বিশেষ কিছু করার। আজকের সাফল্য সেই সব পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের পুরষ্কার হিসাবেই আল্লাহ্ দিয়েছেন।
প্রশ্ন: লীগের পার্ফরমেন্সে আপনার নিজের কাছে তৃপ্তি এবং অতৃপ্তির জায়গা কোনটি?
মিজানুর রহমান: নিজের পার্ফরমেন্স অনেক ভাল লেগেছে। কিন্তু সুপার লীগটা খেলতে পারলে হয়তোবা আরও একটু ভালো অনুভব করতাম। তাছাড়া বৃষ্টির কারনে অনেক গুলো ম্যাচ কার্টেল ওভারে হয়েছে, ফলে একটা চাপও ছিলো সবসময়। হয়তো পুরো ওভার খেলতে পারলে আরো কিছু অতিরিক্ত রানও করতে পারতাম।
প্রশ্ন: আপনার স্কিল, টেকনিক, ফিটনেস এখন দারুণ! এসবের আরো উন্নতি নিয়ে ভাবনা কি?
মিজানুর রহমান: আমি এসবকে সবসময় আন্তর্জাতিক মানের করতে চাই। কারন আন্তর্জাতিক একটি ম্যাচ খেলতে হলে স্কিল, ফিটনেস, টেকনিক, টেম্পারমেন্ট সবকিছুই অনেক অনেক উন্নত হতে হবে।
প্রশ্ন: সর্বোচ্চ রান করার পর জাতীয় দলে ফেরার ব্যাপারে আপনার ভাবনায় কি ছিলো?
মিজানুর রহমান: আসলে জাতীয় দল নিয়ে ভাবনাতে অনেক কিছুই ঘুরপাক খায়, তবে খুব বেশি চিন্তিত হইনা এসব নিয়ে। আমি মনে করি, জাতীয় দলে খেলা বেসিক্যালি ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যে থাকলে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ আসবেই বলে আমি মনে করি। আমি শুধু যা করতে পারি (ভালো ব্যাটিং), তা করে যেতে চাই সবসময়।
প্রশ্ন: জিম্বাবুয়ে সফরের জন্য দল ষোষিত হয়েছে। লীগে আপনার চেয়ে কম রান করেও কয়েকজনের সুযোগ হলেও আপনাকে রাখা হয়নি, কি ভাবে দেখছেন?
মিজানুর রহমান: নিজের কাছে খারাপ লাগার কোন ব্যাপারই এখানে নেই। দেখুন, জিম্বাবুয়ে সফরে টপ অর্ডারে তো নতুন কেউ আসেনি। নতুন মুখ বলতে শামীম। ও ইয়াং ট্যালেন্টেড একজন খেলোয়ার। ও ওর যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। মাঠের তিন বিভাগেই (ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং) ও (শামীম) দুর্দান্ত একজন ক্রিকেটার।
প্রশ্ন: সেরা ফর্মে থাকা সত্ত্বেও দলে সুযোগ হলোনা, কেমন লাগছে? এতে নিজের কতটা ব্যর্থতা দেখেন?
মিজানুর রহমান: অবশ্যই খারাপ লাগছে, কিন্তু আশাহত হইনি। আপনাদের সবার দোয়াতে ইনশাআল্লাহ্ আমি একদিন না একদিন খেলবো, এটা আমার বিশ্বাস। আর অবশ্যই নিজের ব্যর্থতাও দেখি। সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছি ব্যর্থতাগুলোকে জয় করার। আমার জন্য দোয়া করবেন।
প্রশ্ন: এক যুগ হলো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলছেন। জাতীয় দলের জন্য কতটা প্রস্তুত বলে নিজেকে মনে করেন?
মিজানুর রহমান: আমি সবসময়ই জাতীয় দলে খেলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখি। আমি যেখানেই খেলি না কেন, সবসময় সে স্থানের চিত্রটা আন্তর্জাতিক একটা ম্যাচের মত করে আঁকি। আমার ভাবনা জুড়ে থাকে, আমি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যাট করছি এবং আন্তর্জাতিক মানের সব বোলাররা বল হাতে আমার দিকে ছুটে আসছে।
প্রশ্ন: জাতীয় দলে সুযোগ হচ্ছেনা, হতাশা গ্রাস করেছে কখনো? নির্বাচকদের প্রতি কখনো অভিমান জমেছে?
মিজানুর রহমান: না, আসলে আর হতাশ হইনা আমি। আগে একটু আধটু হতাশা গ্রাস করতো। তবে তখন হয়তো আবেগ দিয়ে সবকিছু বিচার করতাম। এখন বাস্তবতা বুঝি। যখন নির্বাচকরা মনে করবে যে আমি জাতীয় দলে খেলার যোগ্য, তখন আমি খেলবো, এই বিশ্বাসে এগিয়ে যাচ্ছি। আর সত্যি বলতে আমি সবসময় বিশ্বাস করি, আমাদের নির্বাচকমন্ডলীরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝেন। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এদেশের ক্রিকেট জাগরণে তাঁদের অবদান। ক্রিকেট বিষয়ে তাদের জ্ঞান কম হলে আজ হয়তো আমরা এভাবে ক্রিকেট খেলারই সুযোগ পেতাম না। আইসিসি ট্রফি জয় থেকে শুরু করে ওয়ানডে ও টেষ্ট স্ট্যাটাস, সবই যে তাঁদের ক্রিকেট মেধার সাক্ষী! তাই তাদের প্রতি কোন অভিমান কখনোই ছিলোনা, এখনো নেই। আর উনারা সবসময়ই আমাকে নিয়ে পজেটিভ। একবার তো নান্নু ভাই (মিনহাজুল আবেদিন নান্নু) আমার খেলা দেখতে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন। আমি মনে করি, হয়তো আমার ভেতর তাঁরা কোন কিছুর ঘাটতি দেখেছেন। এই ঘাটতি দূর করতে পারলেই আমকে ডেকে নিবেন। আর তাছাড়া আশাহত হলে তো সমস্যা, পার্ফরমেন্সের উপর ইফেক্ট করবে।
প্রশ্ন: নান্নু ভাইয়ের কথা যখন বললেন-ই, তখন কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন এসেই যায়। ২০১৮ সাল, সেবার জাতীয় লীগে টানা পাঁচ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন। আমার যদি ভুল না হয়, তবে, সিলেটের বিপক্ষে ১৪৩, চট্টগ্রামের বিপক্ষে ১০২, ঢাকা মহানগরের বিপক্ষে ১৭৫, খুলনার বিপক্ষে ১১৫ এবং রংপুরের বিপক্ষে ১৬৫ রানের ইনিংস খেলেন আপনি। সেবার টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করে তামিম ইকবালের রেকর্ডেও ভাগ বসিয়েছিলেন। তার ক’দিন পরেই কিন্তু জিম্বাবুয়ে এবং উইন্ডিজের সাথে দুটি সিরিজও ছিলো। সে সময় প্রথম সারির কয়েকজন, বিশেষ করে সাকিব ও তামিম ইনজুরির কারনে দলের বাইরে। অর্থাৎ সবকিছুই ছিলো আপনার পক্ষে, তবুও তখন আপনার উপর আস্থা রাখতে পারেননি নির্বাচকরা। কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মিজানুর রহমান: দেখুন, আমি আগেই বলেছি, হয়তো আমার ভেতর তাঁরা কোন কিছুর অভাব দেখেছেন, আর সে কারনেই এত কিছুর পরও আমাকে বিবেচনায় রাখেননি। ক্রিকেট নিয়ে অবশ্যই আমার থেকে তাঁদের জ্ঞান কম না। তাই আমি সবসময় তাঁদের সকল সীদ্ধান্তকে সম্মান জানাই এবং নিজের দুর্বলতাগুলোকে খুঁজে বের করে তা সংশোধনের চেষ্টা করে যায়। দেখেন, বিভিন্ন দুর্বলতাকে সঙ্গী করে জাতীয় দলে খেললাম, দুই ম্যাচ খেলে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে গেলাম, সেটা কি ভালো হবে? নাকি সবকিছু শিখে, সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে জাতীয় দলে দীর্ঘদিন সার্ভিস দেওয়া ভালো হবে? নির্বাচকরা হয়তো আমার ভালোটাই চান। হয়তো তাঁরা চান আমি দীর্ঘদিন সার্ভিস দেই। আসলে তাঁরা তো আমাদের অভিভাবক, বাবা-মার মত। আর কোন বাবা-মা কি চান, তার সন্তান কোন কাজে ব্যর্থ হোক? হয়তো আমাদের নির্বাচকরাও চাননা, আমি ব্যর্থ হই, দু-চারটা ম্যাচ খেলে অনেকের মত হারিয়ে যায়! আমি আসলে এভাবে ভাবি বিষয়টাকে। এ্যাকচুয়ালি আ’ম অলোয়েজ বি পজেটিভ এ্যাবাউট দেয়ার অল ডিসিশন।
প্রশ্ন: জাতীয় দলে খেলার জন্য আর কতটা পরিশ্রম করতে চান? এবারের পার্ফরমেন্স কে কি সর্ব্বোচ্চ বলতে চাননা?
মিজানুর রহমান: অবশ্যই পরিশ্রম সবসময়ই করি এবং ইনশাআল্লাহ্ সামনে আরো পরিশ্রম করার চেষ্টা করে যাবো। যেখানে যেখানে আমার সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করবো। আর এবারের পার্ফরমেন্স যে সর্বোচ্চ ভালো, তা বলবো না। যতদিন ক্রিকেট খেলবো রেকর্ডের পর রেকর্ড হতে থাকবে। একটা রেকর্ড হয় আরেকটা রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য। আমি চেষ্টা করবো এখন যে পার্ফরমেন্স করছি, সামনে তার থেকে আরো বেটার কিছু করার।
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের এবারের সামগ্রিক আয়োজনটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মিজানুর রহমান: এক কথায় অসাধারণ। আমি বিপিএল খেলেছি, তাই বলতে পারি, বিপিএল এবং এবারের ডিপিএলের মধ্যে একটাই পার্থক্য মনে হয়েছে, আর তা হলো এখানে বিদেশি ক্রিকেটার নেই! সম্প্রচার থেকে শুরু করে সকল ফ্যাসিলিটিজে আর তেমন কোন পার্থক্য দেখিনি। একটি দিক থেকে বলবো, বরং এগিয়েই ছিলো, সেটি হলো জৈব সুরক্ষা। করোনার মত ভয়ংকর এক শত্রুর কাছ থেকে যেভাবে বিসিবি খেলোয়ারদের আগলে রেখেছে তা কিন্তু আইপিএলের মত আসরকেও হার মানিয়েছে। এ জন্য বিসিবি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ দিলে তা অনেক কম হবে। আসলে এটি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকার মত বিষয়। তাই বিসিবি সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল হতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
প্রশ্ন: যারা আপনার সাক্ষাৎকারটি পড়লো, তাদের কিছু বলার আছে?
মিজানুর রহমান: প্রত্যেক খেলোয়ারের স্বপ্ন থাকে, দেশের জার্সি গায়ে চাপানোর। আমারও স্বপ্ন, আমি একদিন সেই জার্সি গায়ে চাপিয়ে মাঠে নামবো। জানিনা সে সুদিন কবে আসবে। তবে আমি সবসময় আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি, আপনারা সকলেই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন আমার স্বপ্নকে সত্যি করতে পারি। আপনাদের সকলের জন্য দোয়া, ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
স/অ