আবাসন ব্যবসার অনুমোদন নেই আরডিএর: ভবন নির্মাণ নিয়েও প্রতারণা মোস্তাফিজের


নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজশাহী নগরীতে আবাসন ব্যবসা করতে হলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) অনুমোদিত ব্যবসায়ী হতে হবে। কিন্তু ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নাই আরডিএতে। তার পরেও গত প্রায় ৪ বছর বছর ধরে রাজশাহী নগরীতে আবাসন ব্যবসার নামে প্রতারণা করে যাচ্ছে ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। ফ্ল্যাট ক্রেতাদের অভিযোগ, আরডিএর নকশা অনুযায়ী ফ্লাটের আকার নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ফলে যারা ঋণ করে ফ্ল্যাট কেনার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটিকে অগ্রিম টাকা দিয়েছেন তাঁরা আর ঋণ নিতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে জমি-জমা বা নিজের শেষ সম্বল বিক্রি করে মোস্তাফিজকে টাকা পরিশোধ করছেন ফ্য¬াট ক্রেতারা।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, রাজশাহী নগরীতে ব্যবসা করতে আবাসন ব্যবসায়ীদের অবশ্যই আরডিএ’র নিবন্ধন নিতে হবে। সে অনুযায়ী আরডিএ’র তালিকাভূক্ত বৈধ ব্যবসায়ী আছেন ২৬ জন। যার মধ্যে ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’ নামে কোনো আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নাই। তার পরেও এ প্রতিষ্ঠানটি অন্য কোনো অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে আবাসন ব্যবসা করছে। যেটিও আইনসিদ্ধ নয়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান রাজশাহী নগরীর ঘোড়ামারা এলাকায় গ্রীণ প্যালেস নামের একটি সাততলা ভবন নির্মাণ করছেন। ভবনটির ছাদ ঢালাইসহ প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু বাকি কাজগুলো তিনি কওেত গড়ি-মশি করছেন। যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন তাঁদেরকেই এখন কাজ করে ফ্লাটে উঠতে হচ্ছে।

এমন একজন ফ্ল্যাট ক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, তিনি ১৮৫০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট তিন বছর আগে মোস্তাফিজের কাছে কেনেন গ্রীণ প্যালেসে। মোস্তাফিজ ৬০ লাখ টাকার ওপরে দাম ধরে প্রথমে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ করেছিলাম মোস্তাফিজকে। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, বাকি টাকা তিনি ঋণ পাইয়ে দিয়ে সম্নয় করে নিবেন।

পরবর্তিতে ব্যাংক ঋণ করতে গিয়ে দেখা যায় ওই ফ্ল্যাটের আরডিএর নকশা অনুমোদন আছে ১৭২০ স্কয়ার ফিট। নকশার বাইরে প্রায় ১৩০ স্কয়ার ফিট অতিরিক্ত করা হয়েছে অবৈধভাবে। ফলে আর ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও জানান, ‘ব্যাংক ঋণ না পেয়ে আমি অনেক কষ্টে পরবর্তিতে মোস্তাফিজকে আর ১০ লাখ টাকা দেয়। এর পর ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি দিলে বাকি টাকা পরিশোধ করতে চাই। কিন্তু সে এরই মধ্যে অন্য এক ব্যক্তির কাছে ওই ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেয়। তাঁকেও রেজিস্ট্রি করে দেয়নি। বাধ্য হয়ে আমি মেয়র সাহেবের কাছে অভিযোগ করি। এর পর মেয়রের হস্তক্ষেপে মোস্তাফিজকে আবার ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য টাকা দেয়। কিন্তু সেটিও করেনি। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি নিজের টাকা দিয়ে বাঁকি কাজটুকু সম্পন্ন করছি। তার পরেও রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছে ফ্ল্যাটটি রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন না মোস্তাফিজুর রহমান।’

তিনি আরও বলেন, আমার সঙ্গে করা চুক্তি বাইরে এখন আরও কয়েক লাখ টাকা বেশি চাচ্ছেন মোস্তাফিজ। না হলে রেজিস্ট্রি দিবে না বলে হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু আমি এতো টাকা এখন কিভাবে দিব? এমনিতেই ধার-দেনা জড়িয়ে পড়েছি। এখন গ্রামে যে বাড়ি আছে, সেটি বিক্রি করে ওকে টাকা দিতে হবে।’

ওই ভবনে এখন পর্যন্ত চারটি পরিবার উঠেছে। অপর একটি ফ্ল্যাটের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রায় এব বছর হলো আমরা ভবনটিদে উঠেছি। অনেক কাজ আমাদেরকে টাকা দিয়েই করতে হয়েছে। এছাড়াও ভবনটিতে এখনো লিফলেট লাগানো হয়নি। জেনারেটরও বসানো হয়নি। এর বাইরে অন্যান্য সুবিধাও তেমন নাই।’

তিনি আরও জানান, ভবনটির তিনটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব দিকের প্রতিটি তলায় ১৮৫০ স্কয়ার ফিটের একটি করে ইউনিট আছে। যার মধ্যে ১৩০ স্কয়ার ফিটই অতিরিক্ত। এর বাইরে অন্যা দুটি ইউনিটেও নকশার বাইরে গিয়ে অন্তত ১০০ স্কয়ার ফিট করে ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত অংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রতিটি তলায় তিনটি ইউনিট মিলে প্রায় ৪০০ স্কয়ার ফিট অতিরিক্ত করা হয়েছে।

পাশের এক বাসিন্দা আনসার আলী বলেন, ভবনটি নির্মাণের সময় নানা অনিয়ম দেখে আমরা বার বার আরডিএতে ফোন করে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। চারিদিকে এক ফিটও জায়গা ছাড়েনি আবাসন ব্যবসায়ীরা। অবৈধভাবে প্রতিটি ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত অংশ বৃদ্ধি করে বাণিজ্য করেছে তারা।’

আরডিএ’র নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য অন্তত তিন ফিট চারিদিকে ছাড়তে হবে। কিন্তু সেটিও মানা হয়নি এই ভবনটি নির্মাণ করতে গিয়ে। চারদিকে একেবারে সীমানা প্রাচীল ঘেঁষে বসানো হয়েছে ভবনের পিলার। আর প্রাচীর লাগোয়া গড়ে তোলা তোলা হয়েছে ভবনের বাইরের অংশ।’

একইভাবে অনিয়ম করে আরেকটি ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে নগরীর ওই বরেন্দ্র এলাকার পেছনে। এখানে গ্রীণ মনোনয়ারা প্যালেস নামের ৬ তলা ভবনটির প্রতিটি ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে ১৩৫০ ও ১৪৫০ স্কয়ার ফিট হিসেবে। এখানেও প্রতিটি ইউনিটে ১০০-১৫০ স্কয়ার ফিট অতিরিক্ত করা হয়েছে অনুমোদিত নকশার বাইরে।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্র মতে, গ্রীণ প্যালেসের নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আব্দুল ওয়াহাবসহ সাতজন ব্যক্তির নামে। তাঁরাই মূল জমির মালিক। ওই ভবনের নকশা অনুমোদন আছে প্রতিটি ফ্লোরে (তলায়) ৩০৭৭ স্কয়ার ফিট করে। কিন্তু বাস্তবে রয়েছে প্রায় ৪ হাজার স্কয়ার ফিট করে। অন্যদিকে গ্রীণ মনোনয়ারা প্যালেস নামের ভবনটির প্রতিটি ফ্লোর অনুমোদন রয়েছে ৩২২৬ স্কয়ার ফিট করে। এটির নকশা অনুমোদন আছে সওকত ওসমান ও ইকবাল হাসানসহ ৭ জনের নামে। তাঁরাই জমির মূল মালিক। এই ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে ইউনিট রয়েছে। যার গড় অন্তত ৫ হাজার ২০০ স্কয়ার ফিট করে রয়েছে। বিপুল পরিমাণ অংশ অতিরিক্ত করা হয়েছে নকশার বাইরে গিয়ে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথোরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল এ্যাস্টেট’ নামে আমাদের কোনো নিবন্ধিত আবাসন প্রতিষ্ঠান নাই। আরডিএ’র নিবন্ধিত আবাসন প্রতিষ্ঠান ছাড়া আবাসন ব্যবসা করারও কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু এসব অবিনন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসাজস করে অথবা জমির মালিকের নামে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নেই। এর পর তারা ব্যবসা করে। তবে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, ‘গ্রীণ প্যালেস ও গ্রীণ মনোয়ারা প্যালেসে নকশার বাইরে অতিরিক্ত অংশ করা হয়েছে। আমরা অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলার জন্য চিঠি দিবো। প্রাথমিকভাবে তাদের কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছি।’

জানতে চাইলে ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল এ্যাস্টেট’ প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ম্যানেজার মাসুদ রানা বলেন, ‘গ্রীণ মনোয়ারা প্যালেসে এখন ফ্ল্যাট আছে বিক্রির মতো। প্রতিটি ফ্লোরে চারটি ইউনিট আছে। অতিরিক্ত অংশ করা হয়েছে কিনা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করিনি। নিয়ম মেনেই আমি ব্যবসা করছি। আমার সমস্ত ডকুমেন্ট আছে। কোনো কিছুই অনিয়মের মধ্যে হয়নি।’

এদিকে, রাজশাহীর আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রেডার সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল এ্যাস্টেট’ আমাদের সংগঠনের সদস্য। যে কোনো আবাসন ব্যবসায়ী এই সংগঠনের সদস্য হতে পারে। তবে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বসবো।’

প্রসঙ্গত, ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল এ্যাস্টেট’র এই আবাসন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে গতকাল ২১ মার্চ একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশিত হয়।