আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ও বাংলাদেশ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আমরা জানি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। নাগরিক মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সঙ্গে শিক্ষা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি সভ্য ও উন্নত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই এর সঠিক জবাব ও প্রমাণ আমরা পেয়ে যাব। শিক্ষিত ও সাক্ষরতা এক জিনিস নয়। একজন মানুষ যখন প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন আমরা তাকে শিক্ষিত বলতে পারি। কিন্তু সাক্ষর মানে হলো কেবল অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। যিনি কেবল বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হন, দৈনন্দিন কার্যাবলি সাড়ার জন্য বাজারের তালিকা করা, রাস্তার সাইনবোর্ড ও বাসার ঠিকানা পড়া, চিঠিপত্র পড়া, মোবাইল নম্বর চেনা, টেলিফোন ও মোবাইল করতে পারা, নম্বর সেভ করতে পারা, সর্বোপরি নিজের নাম লিখতে পারা এবং স্বাক্ষর কিংবা দস্তখত করতে পারা—এমন জ্ঞানসম্পন্নদের সমাজে সাক্ষর বলা হয়ে থাকে। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, শিক্ষিত ও সাক্ষরতার মধ্যে কত ফারাক!

 

অথচ এইটুকু সাক্ষরতা নিয়েই বিশ্বে শিক্ষার পরিসংখ্যান দেখলে হতাশ হতে হয়। কারণ, বর্তমান আধুনিক ও ডিজিটাল বিশ্বেও যদি লেখাপড়ায় নাগরিকরা এগিয়ে যেতে না পারে, তবে তা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। আর সে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেই জাতিসংঘ ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে এ দিবস আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে পালিত হয়ে আসছে। গত বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে এর ৫০তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে। বিশ্ব হিসাবে ৭৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা খুব কমই সাক্ষরতাসম্পন্ন। আরেক রিপোর্টে জানা যায়, প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে মাত্র একজন মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয়, যেখানে তার তিন ভাগের দুই ভাগ হলো নারী। ৬০ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশু এখনো স্কুলের বাইরে এবং এরা অনিয়মিতভাবে স্কুলে উপস্থিত হয় এবং একপর্যায়ে ড্রপ আউট হয়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে বিশ্বে ১৫ থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের জন্য সাক্ষরতার হার ৮৬.৩ শতাংশ, তার মধ্যে পুরুষ ৯০ ও নারী ৮২.৭ শতাংশ। ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৬ সালের গ্লোবাল মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিম আফ্রিকায় সবচেয়ে কম সাক্ষরতার হার, অর্থাৎ ৫৮ দশমিক ৬, সাব-সাহারান আফ্রিকায় ৫৯.৭ ও আরব রাষ্ট্রগুলোয় ৬২.৭ শতাংশ। বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে কম সাক্ষরতাসম্পন্ন, তার মধ্যে বার্কিনা ফাসো (১২.৮ শতাংশ), নাউজার (১৪.৪ শতাংশ) এবং মালি (১৯ শতাংশ) মাত্র। ২০১৫ সালের হিসাবে এ সাক্ষরতার হার কিছুটা বেড়ে হলো সাব-সাহারান আফ্রিকায় ৬৪ শতাংশ। আর এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান, যেসব দেশ সাক্ষরতায় পিছিয়ে, তারা দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অর্জন করতে পারছে না এবং তাদের দেশে সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হলো নারী ও শিশুরা। জাতিসংঘ কর্তৃক কিছু নির্ধারিত উদ্দেশ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়ে থাকে। আর তার মূল লক্ষ্য হলো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা।

 

২০০৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে জাতিসংঘ সাক্ষরতা দশক ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে এর সঙ্গে স্বাস্থ্যশিক্ষা যুক্ত করে ‘সাক্ষরতা এবং স্বাস্থ্য’ হিসেবে তা পালিত হয়েছিল। ঠিক সেভাবে ২০১১-১২ সালে এ দিবসের থিম ছিল ‘সাক্ষরতা ও শান্তি’। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে সাক্ষরতার বর্তমান হার ৭০ শতাংশের বেশি, কিন্তু ইউনেস্কা কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে তা ৬১.৫% (সার্বিক) এবং পুরুষের ক্ষেত্রে তা একটু নারীদের চেয়ে এগিয়ে, অর্থাৎ ৬৪.৬%। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোতে সাক্ষরতার হার ৯৯.২ শতাংশ এবং ওশেনিয়ায় ৭১.৩ শতাংশ, দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ায় ৭০.২ শতাংশ। তবে বিশ্ব পরিসংখ্যানের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার (৭০ শতাংশ) যে খুব কম, তা নয়; বরং সমসাময়িক ও সমপর্যায়ের, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছি। আর সে জন্যই আজ হয়তো আমার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে এগিয়ে যেতে পারছি।

 

দেশ থেকে আগামী দিনে নিরক্ষরতা চলে গিয়ে শতভাগ সাক্ষরতার দিকে এগিয়ে যাবে—এটাই হোক এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের শপথ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যারা এখনো সাক্ষরতায় তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারেনি, সবারই তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

 

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: এনটিভি