আত্মসমর্পণে কি মাদকের সরবরাহ বন্ধ হবে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী (যঁাদের ইয়াবা গডফাদারও বলা হয়) অস্ত্র, মাদকদ্রব্যসহ আত্মসমর্পণ করেন। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক জিরো টলারেন্স নীতির আওতায় চলমান মাদকবিরোধী অভিযানেরই ফল। মে ২০১৮ থেকে পুলিশ ও র‍্যাব মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযানে পুলিশ ও র‍্যাবের সঙ্গে ‘এনকাউন্টারে’ প্রায় ৪০০ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। টেকনাফেও কয়েকজন নিহত হয়েছেন। পুলিশি অভিযানে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এসব মাদক কারবারি পুলিশের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ ধরনের আত্মসমর্পণ সমাজে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়। এটা মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকে আরও গতিশীল করবে এবং অন্যরাও অপরাধের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। মাদক চোরাচালানও হ্রাস পাবে।

আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে টেকনাফ এলাকায় জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ লোক আত্মসমর্পণকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এতে তেমন কোনো ফল দেবে না। তাঁদের কথা, আত্মসমর্পণকারীদের মাদক ব্যবসার নেটওয়ার্ক এলাকায় বিরাজ করছে। তারা বিচিত্র উপায়ে এবং নতুন নতুন এজেন্ট নিয়োগ করে মাদক তথা ইয়াবা চোরাচালান অব্যাহত রাখবে। তাঁদের এ কথার ভিত্তি আছে। আত্মসমর্পণের দিন এবং পরবর্তী সময়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রচুরসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার করেছে। তার মানে হচ্ছে, এত কিছু করেও মাদক ব্যবসায়ীদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দাবি, অভিযান ও আত্মসমর্পণের পর টেকনাফ দিয়ে ইয়াবার সরবরাহ ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মাদককে শতভাগ নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে। তবু প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো ও কলম্বিয়া থেকে মাদক আসা বন্ধ করতে পারেনি। তবে অনেক দেশই মাদকের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের মধ্যে স্বস্তি আনতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলো এবং এশিয়ার সিঙ্গাপুরকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। সরকার সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। কিন্তু কাজটি বড়ই কঠিন।

কক্সবাজারের টেকনাফ বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশের প্রধান রুট। এ কারণে টেকনাফে অসংখ্য লোক ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমারে। মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীরা সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশে ইয়াবা সরবরাহ করেন। গ্রেপ্তারকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, ইয়াবা কেনার জন্য কোনো অগ্রিম বা নগদ টাকা দিতে হয় না। ইয়াবার চালান কক্সবাজার জেলার সীমানা পার হলে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা হয়।

কেবল মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হলে এবং তঁারা আত্মসমর্পণ করলে কিংবা এনকাউন্টারে নিহত হলেই মাদক বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। যদি দেশের ভেতরে মাদকের চাহিদা থাকে, তবে যেকোনো উপায়েই হোক মাদকাসক্তদের কাছে তা পৌঁছে যাবে। এক ব্যবসায়ী ব্যবসা ছাড়লে অন্য ব্যবসায়ী সৃষ্টি হবে। পুরোনো রুটের পরিবর্তে নতুন নতুন রুটের সৃষ্টি হবে। কারণ, মাদক ব্যবসা খুবই লাভজনক ব্যবসা। একজন মাদক ব্যবসায়ী এক লাখ ইয়াবা তার নির্ধারিত স্থান পার করে দিলে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা মুনাফা পান। কাজেই অধিক টাকা রোজগারের নেশায় ব্যবসায়ী কিংবা পরিবহনকারীরা জীবনের ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।

এ জন্য মাদকের সরবরাহ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। চাহিদা হ্রাসের জন্য যারা মাদকাসক্ত, তাদের আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে হবে। আর নতুন করে যেন কেউ মাদকে আসক্ত না হয়, তার জন্য ব্যাপক গণসচেতনতা ও শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মাদকের কুফল ও ভয়ানক পরিণতির কথা তরুণ-কিশোর ও যুবকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, এনজিও, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ধর্মীয় ব্যক্তি তথা আলেম-ওলামা সমাজ, সুশীল সমাজ সর্বোপরি প্রতিটি পরিবার এবং সব শ্রেণি-পেশার লোককে মাদকবিরোধী প্রচারণায় ও গণসচেতনতামূলক কার্যক্রমে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে মাদকের কুফল সম্বন্ধে বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আত্মসমর্পণ করা মাদক ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার চিন্তাভাবনা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তঁাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেছেন। এ বিষয়ে সরকারকে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যঁারা মাদক ব্যবসা করে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন, তঁাদের আর্থিকভাবে পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। জীবনের ভয়ে তাঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন। মাদকের নেটওয়ার্ক তঁাদের জানা। মাদক ব্যবসা করে কাঁচা টাকা রোজগারের যে নেশা তঁাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে তাঁরা সহজে মুক্ত হতে পারবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুযোগ পেলেই তঁারা পুনরায় মাদক ব্যবসা শুরু করতে পারেন। তাই তঁাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক চাপে রাখার পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তঁাদের বিরুদ্ধে যদি মামলা থাকে, তা প্রশাসনিক আদেশে প্রত্যাহার করা সমীচীন হবে না। বিচারের মাধ্যমেই তা
নিষ্পত্তি করতে হবে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করে তঁাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রেপ্তার করা ও আত্মসমর্পণ করা মাদক ব্যবসায়ীরাই হুন্ডি ব্যবসায়ীদের তথ্য দিতে পারবেন।

আত্মসমর্পণ করা মাদক ব্যবসায়ী যঁারা দরিদ্র, তঁাদের পুনর্বাসনের চিন্তা করা যায়। পুনর্বাসন করা ব্যক্তিদের নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে, যাতে তঁারা পুনরায় মাদক ব্যবসায় ফিরে না যান। একইভাবে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ফলোআপের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে পুনরায় তঁারা মাদকাসক্ত না হন। মাদকের সরবরাহ বন্ধ, মাদকসেবীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, দরিদ্র মাদক ব্যবসায়ী ও পরিবহনকারীদের পুনর্বাসন এবং সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্যাপক গণসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ও জনসাধারণের এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।