আগাম মাঠ দখল লিটনের, গুছিয়ে উঠতে পারছেন না বুলবুল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

১৯৮৮ সালের রাজশাহী সিটি করপোরেশন গঠন হওয়ার পরে সবমিলিয়ে প্রায় ২১ বছর মেয়র হিসেবে ক্ষমতা ভোগ করেন বিএনপি নেতারা। তাঁদের মধ্যে প্রায় ১৪ বছর মেয়র হিসেবে ছিলেন বর্তমানে দলটির চেয়ার পার্সনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দুই বছর কাটান বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউন্নবী দুদু এবং গত ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন সদ্য পদ্যতাগকারী মেয়র ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। যদিও প্রায় দুই বছর ক্ষমতার বাইরে জেলে বা কারাগারে কাটাতে হয়েছে বুলবুলকে। এই সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম-উল আযিম। আর ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মেয়র ছিলেন বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

ফলে ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ এই ৩০ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা হিসেবে মেয়রের ক্ষমতা ভোগ করেন প্রায় সাত বছর। আগামী ৩০ জুলাই রাসিকের যেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এই নির্বাচনেও বড় দুটি দলের দুই মেয়র প্রার্থীর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠবে বলেই মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। তবে এবারই প্রথম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার আগ থেকেই মাঠ দখল করে রেখেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। ফলে অনেকটায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বিএনপি। অথচ বিগত ত্বতাবধায়ক সরকার আমলেও নেতাকর্মীহীন অবস্থায় থাকলেও বিএনপি এমন পরিস্থিতির শিকার হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাসিক নির্বাচনকে ঘিরে গত প্রায় ৬ মাস ধরে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে লিটনের পক্ষে। এই সময়ে নগরজুড়ে ব্যাপক ব্যানার, ফেস্টুন এবং বিলবোর্ড টাঙাগানো হয় লিটনকে আগামী নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছে। চলো বদলে দেয় রাজশাহী স্লোগাানে নগরীর রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও ওয়ালে ওয়ালে সভা পেতে থাকে লিটনের নির্বাচনী ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড।

সেখানে মেয়র থাকা অবস্থায়ও সহজে চোখে পড়েনি বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ব্যানার, ফেস্টুন। তবে গত জুন মাসের শুরুর দিকে কিছু ব্যানার, ফেস্টুন নগরীতে টাঙ্গানোর চেষ্টা করেন বুলবুল। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হোন তিনি। কারণ যেখানেই বুলবুলের ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো বা টাঙ্গানো হয়, সেখানেই রাতারাতি সেগুলো সরিয়ে দিয়ে লিটনের ব্যানার, ফেস্টুন গিয়ে বসে। ফলে ব্যানার, ফেস্টুন টাঙ্গানোর স্থানও হারিয়ে ফেলেন বুলবুলের নেতাকর্মীরা।

গত কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই নতুন করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা নিয়ে। প্রতিদিন নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে নানাভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেখানে বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের নেতৃত্বে ছাড়া কোনো ওয়ার্ডেই নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে প্রচারণা চালাতে দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গোটা নগরজুড়ে লিটনময় হয়ে উঠেছে সাধারণ ভোটারদের মাঝে।

বিএনপি দলীয় সূত্র মতে, নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা হওয়ার পর বিএনপির উদ্যোগে বুলবুলকে নির্বাচিত করার লক্ষ্যে গত ৩০ জুন নগরীর সিটি কনেভেনশস সেন্টারে দলীয় সভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু প্রশাসন সেখানে অনুমতি না দেওয়ায় ওই সভা অনুষ্ঠিত হয় মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে ছোট পরিসরে। এরপর গত ২ জুন রাজশাহী মেডিক্যল কলেজ অডিটোরিয়ামে রাজশাহী বিএনপির বর্ধিতসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু ওইদিনই সেখানে রাজশাহী আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দলটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

সেখানে আওয়মাী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ রাজশাহীর ৫টি আসনের এমপিরাও উপস্থিত ছিলেন। ওইসভা থেকে রাজশাহী আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীকে একজোট হয়ে লিটনের জয় নিশ্চিত করতে সবাইকে কাজ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। প্রক্ষান্তরে একইদিন নগরীর মুনলাইট গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির বর্ধিত সভা।

এখানে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচবি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ রাজশাহী মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। তবে রাজশাহীর সাবেক এমপিদের মধ্যে একমাত্র মিজানুর রহমান মিনুছাড়া এখনো কোনো সভায় উপস্থিত করতে পারেননি বুলবুল। আবার মহানগর বিএনপি ও যুবদলের মধ্যেই রয়েছে এখনো চরম কোন্দ্বল। ফলে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে একমাত্র বুলবুলের নেতৃত্বেছাড়া কোথাও বিএনপি, যুবদল বা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে বুলবুলের সঙ্গে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন ও সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু ছাড়া তেমন নেতাকর্মীকেও মাঠে নামতে দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে গোটা নগরীর ৩০ ওয়ার্ডেই সাধারণ ভোটারদের মাঝে একচেটিয়াভাবে প্রচারণায় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

এর বাইরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ইমাম, শিক্ষক আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে তাঁর হয়ে নির্বাচনী মাঠে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। পাশাপাশি পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নগরীর উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন লিটন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত একটি সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারেননি বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। ফলে সেইদিক থেকেও চরমভাবে পিছিয়ে পড়েছেন বুলবুল।

নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলছিলেন, লিটন ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নগরীতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেন। কিন্তু গত ৫ বছরে থমকে যায়, সেই উন্নয়নকর্মকা-। এর ফলে এমনিতেই এবার নির্বাচনে লিটনকে মানুষ এগিয়ে রাখছেন। এর ওপর বিএনপি নেতাকর্মীদের নিরব ভূমিকার কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একচেটিয়াভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে লিটনের প্রচারণায় বেশি হচ্ছে নগরীতে। এতে করে এগিয়ে গেছেন লিটন। সেখানে পিছিয়ে পড়েছেন বুলবুল।

নগরীর লক্ষীপুর এলাকার ব্যবসায়ী বাবু বলেন, ‘এবার লিটনের প্রচারণা এতো বেশি হচ্ছে-বুলবুলের কথা শোনায় যাচ্ছে না। এই রকম অবস্থা এর আগে কখনো দেখিনি। বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহী নগরীতে বিএনপির এমন নাজুক অবস্থা সিটি করপোরেশন গঠনের পরে এবারই চোখে পড়ছে।

তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও সদ্য সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের মাঠে নামতেই দেওয়া হচ্ছে না। আবার দলীয় সভা করার জন্য বড় কোনো পরিসর চাইলেও সেখানে অনুমতি দিচ্ছে না প্রশাসন। তাহলে কিভাবে নেতাকর্মীরা মাঠে নামবে? তারপরেও নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যব্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে কোনো কোন্দ্বল নাই। সবাই আমাকে নির্বাচিত করতে ঐক্যব্ধ। কিন্তু বর্তমান সরকার খুলনা, গাজীপুরের মতো রাজশাহীতেও ভোট ডাকাতির চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এখানে সেটি করতে চাইলে চরম প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন নেতাকর্মীরা।’

বুলবুল বলেন, ‘রাজশাহী সিটিকে নতুন করে বদলানোর কিছুই নেই। নতুন করে বদলানোর নামে সরকারী দলীয় মেয়র প্রার্থী পুরো শহরটাকে পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের শহরে পরিণত করেছে। তাদের কবল থেকে নান্দনিক স্থান, মনিষিদের ফলকও রেহাই পায়নি। প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল পোস্টার দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। নোংরাতে ভরিয়ে দিয়ে পুরো শহরটাকে ইতোমধ্যে তিনি বদলে দিয়েছেন। ক্লিন সিটির খেতাব ইতিমধ্যে সরকার দলীয় মেয়র প্রার্থী লিটনই বিনষ্ট করেছে বলেও বুলবুল অভিযোগ করেন।

অন্যদিকে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বুলবুল সবদিক থেকেই ব্যর্থ হয়ে তিনি জনসমর্থন হারিয়েছেন। এইবার আর জনগণ তাদের মিথ্যা প্রচারণায় কান দিচ্ছে না। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন বুলবুল। নগরবাসী এবার উন্নয়নের জন্য আমাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চাই। আমি আগামী ৩০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে নগরীকে ঢেলে সাজাতে চাই। নির্বাচিত হলে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাবো। ভোটাররাও আমার দ্বারাই উন্নয়ন সম্ভব বলেই ধরে নিয়েছেন। এ কারণে এবার আমাকেই তারা নির্বাচিত করার জন্য মুখিয়ে আছেন। আশা করি এবার আর কোনো ভুল করবেন না নগরবাসী।’

বুলবুলের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে লিটন বলেন, ‘তাদের দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেই তারা মাঠে নামতে পারছে না। এখানে প্রশাসন কি করবে? প্রশাসন সর্বাত্মকভাবে সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন সব মেয়র পার্থীকে। এই অবস্থায় অবান্তর অভিযোগ করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন বুলবুলে। সেটিও টিকবে না জনগণের কাছে।’

স/আর