‘আঁচল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

কবি আল মাহমুদের অনেক কবিতাই আমি পড়িনি। যা পড়েছি, তার মধ্যে সব কটিই যে পছন্দ হয়েছে, তা–ও নয়। কিন্তু যা পড়েছি, তা থেকেই মুগ্ধ-বিস্ময়ে জেনেছি, কী অসাধারণ শক্তিধর, কী অনন্য এক কবি জন্মেছেন আমাদের এই বাংলাদেশে। প্রায় চার দশক ধরে আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছ, হাতে গোনা কয়েকটি কবিতা ও গোটা কয়েক ছড়া আমি পড়ে যাচ্ছি অবিরাম, অজস্রবার। মুখস্থ করেছি লাইনের পর লাইন।

যখন প্রথম ‘সোনালি কাবিন’ পড়ি, তত দিনে কবি আল মাহমুদ এমন একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বলয়ে চলে গেছেন, যার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার, আমার মনোজগতের দূরত্ব বিশাল। কিন্তু এ জন্য ‘সোনালি কাবিন’–এর রস আস্বাদনে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। সেই কবি এখন তাঁর কবিতায় ইসলামি ভাবধারা প্রচার করছেন বলে অনুপ্রাসের দুর্দান্ত ব্যবহারে অসাধারণ হয়ে ওঠা এই লাইনগুলোর সৌন্দর্য এতটুকুও ম্লান হয়নি,

‘বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানত না যা বাৎস্যায়ন আর যত আর্যের যুবতী।’

‘সোনালি কাবিন’–এর কবি স্বৈরশাসকের বসানো কবিতা আসরে বসে কবিতা পাঠ করছেন দেখে ব্যথিত হয়েছি। কিন্তু এ কারণে তাঁর এই লাইনগুলো মিথ্যে হয়ে যায়নি,

‘পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।’

দুই.
আল মাহমুদ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। একসময় সমাজতন্ত্রের প্রতিও আকৃষ্টও হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে লেখার জন্য জেলে গেছেন। জেল থেকে ফেরার পর তাঁর চিন্তাভাবনায় ইসলামি মূল্যবোধের প্রভাব দেখা দেয়।

ধীরে ধীরে তিনি অত্যন্ত বেমানানভাবে একটি দক্ষিণপন্থী বলয়ে বিচরণ করতে থাকেন। বেমানান এই জন্য বলছি যে একসময় বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডাবাজ আল মাহমুদের তখন যাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল, তাঁদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোজগত ‘সোনালি কাবিন’–এর কবিকে গ্রহণ করার কতটুকু উপযুক্ত ছিল—এই প্রশ্ন সব সময় আমার মনে জেগেছে।

‘সোনালি কাবিন’-এর কবির চিন্তাচেতনায় ইসলামধর্মীয় ভাবধারার সূচনা এবং তার পরিণতিতে তাঁর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক বিচ্যুতি তাঁকে তাঁর পুরোনো বন্ধুবান্ধবের মহল থেকে অনেকটাই নির্বাসিত করে। কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক কারণে কিংবা নানা রকম যোগাযোগের ফলে অতিমূল্যায়িত কিছু কবি-সাহিত্যিকের জন্য এটি একটি সুযোগ হিসেবেও এসেছিল। যে পথে আল মাহমুদ পা বাড়িয়ে ছিলেন, তাঁরা তাঁকে সে পথে আরও ঠেলে দেন।

একবার বইমেলা থেকে হুমায়ুন আজাদের সম্পাদিত বাংলা কবিতার একটি সংকলন কিনেছিলাম। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, বইয়ে আল মাহমুদের কোনো কবিতা নেই! এটা দেখে সম্পাদকের প্রতি প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে বের হওয়া বাংলা কবিতা সংকলনে আল মাহমুদকে না নিলে তা অসম্পূর্ণ থাকবে। রাজনৈতিক বা অন্য কারণে পছন্দ না হলেই কি কাউকে অস্বীকার করা যায়? তা হলে তো মুসোলিনি-হিটলারের পাঁড় সমর্থক এজরা পাউন্ডের নাম ইংরেজি সাহিত্য থেকে বিলীন হয়ে যেত। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’-এর মতো অনেক কুখ্যাত কবিতার কারণে র’ডইয়ার্ড কিপলিং বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। কিন্তু তাই বলে একজন প্রতিভাবান কবি হিসেবে কি তাঁকে অস্বীকার করা যাবে? নাকি অবজ্ঞা করা যাবে তাঁর ‘ইফ..’ কবিতাটিকে—কয়েক বছর আগেও বিবিসির এক জরিপে যা শ্রেষ্ঠ ইংরেজি কবিতা বিবেচিত হয়েছিল!

কোথায় যেন পড়েছিলাম, লেনিন একবার এক স্কুল দেখতে গেছেন। সেখানে তিনি ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেন,
‘তোমরা কার কবিতা পড়ো?’
ছেলেমেয়েরা জবাব দিল,
‘আমরা পড়ি মায়াকোভস্কির কবিতা ।’
মায়াকোভস্কি তখন রুশ বিপ্লবের কবি। তাঁর কবিতা রুশ বিপ্লব ও লেনিনের নেতৃত্বের প্রশস্তিতে ভরপুর।
লেনিন জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমরা পুশকিন পড়ো না?’
‘না। পুশকিন তো বুর্জোয়া।
লেনিন বললেন, ‘পুশকিন কিন্তু আরও ভালো।’

দোর্দণ্ডপ্রতাপ, দুর্বিনীত কবি-অকবির ভিড়ে আমাদের দেশের পুশকিনদের চিনে নেওয়ার আর চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি কে করবেন?

তিন.
নব্বই দশকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে আড্ডায় প্রায়ই আসত আল মাহমুদের কবি প্রতিভার কথা। আল মাহমুদের কবিতার বড় ভক্ত ছিলেন ইলিয়াস ভাই। একসময় ঘনিষ্ঠতাও ছিল। একদিন চাকমাদের প্রসঙ্গে আলোচনার সময় এল এই ছড়াটির কথা:
‘চাকমা মেয়ে রাকমা
ফুল গোঁজে না কেশে
কাপ্তাইয়ের ঝিলের জলে
জুম গিয়েছে ভেসে

জুম গিয়েছে ঘুম গিয়েছে
ডুবলো হাঁড়িকুড়ি,
পাহাড় ডোবে পাথর ডোবে
ওঠে না ভূরিভূরি।’

এই সামান্য কয়েকটি লাইনে কাপ্তাই লেকের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সর্বনাশের কাহিনি বর্ণনা