অর্থনীতিতে থাকবে নানামুখী চাপ

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতে উন্নীত হবে। এতে অনেক রকম বাণিজ্যিক সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন একদিকে যেমন বাংলাদেশের ঋণমান বাড়বে; ঠিক তেমন বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান প্রাপ্তি সংকুচিত হয়ে আসবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের সুদও বাড়বে নিয়ম মোতাবেক।

অনেক বাজারে হয়তো এখনকার মতো সহজ শুল্কমুক্ত সুবিধাও থাকবে না, যদিও ২০২৬ সালের পরের তিন বছর পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধাগুলো বহাল রাখার চেষ্টায় আছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের (গ্র্যাজুয়েশন) আগে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকেই বৈদেশিক ঋণের সুদ কিছুটা বাড়াতে চাইছে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো। যদিও বাংলাদেশ তাদের প্রস্তাবে এখনো সাড়া দেয়নি। উল্টো ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আরও তিন বছরের জন্য সুবিধাদি পেতে লবিং করছে। খবর অর্থবিভাগ সূত্রের।

জানা গেছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলনে এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশসহ উত্তরণকারী দেশগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কত বছর উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কয়েক বছরের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে নেগোসিয়েশন বা আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষত ওষুধ খাতে মেধাস্বত্ব আইনের (ট্রিপস) প্রয়োগে যে ছাড় রয়েছে, তা অব্যাহত রাখার বিষয়ে বাংলাদেশকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা আরও জানিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে অনেক বাজারে হয়তো এখনকার মতো সহজ শুল্ক সুবিধা থাকবে না। এজন্য বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে। তুলনামূলক সুবিধাকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধায় রূপান্তরের জন্য কাজ করার পরামর্শও তাদের।

এদিকে অগ্রাধিকারমূলক বাজার চুক্তি (পিটিএ) নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ (ইইউ) অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে ডব্লিউটিওসহ বিভিন্ন ফোরামে দরকষাকষি চলছে। এ ছাড়া ১০টি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার জন্য একটি তালিকা তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশগুলো হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন ও মালয়েশিয়া। এফটিএ করলে কী সুবিধা হবে, তা নিয়ে গবেষণা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। টেরিটাওয়েলসহ অন্যান্য সহখাত হিসাবে নিলে রপ্তানিতে পোশাক খাতের অবদান দাঁড়ায় আরও অনেক বেশি। এভাবে এক খাতের ওপর অতিরিক্ত রপ্তানি নির্ভরতাকে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি মনে করেন উন্নয়ন সহযোগীরা। তাই ঝুঁকি কমিয়ে রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার তাগিদ দিয়েছেন।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিদেশি ঋণ ও এর সুদ পরিশোধের মাত্রা ছিল বেশি। আলোচ্য সময়ে সরকার যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ পেয়েছে তার প্রায় ৬৮ শতাংশই বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হয়েছে। পরে অবশ্য কিছুটা কমেছে। তবে আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে বিদেশি ঋণ ও এর সুদ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। কেননা বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে পরিকল্পনা কমিশন।

সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থছাড় হয়েছে ৪৩৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৮৫ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ ঋণ প্রাপ্তির ৪২ দশমিক ২১ শতাংশই চলে যাচ্ছে পরিশোধে।

জানা গেছে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার বেড়েছে, যা সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়িয়েছে। সরকার চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে উন্নয়ন অংশীদারদের সুদ ও আসল পরিশোধে ১৮৫ কোটি ডলার ছাড় করেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়কালে এটা ছিল ১২৮ কোটি ডলার। আসছে অর্থবছর এই পরিমাণ আরও বাড়বে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে ঋণের সুদের হার বাড়বে। সব সময় দানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এজন্য তিনি সরকাকে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে দক্ষতা বাড়ানোর কথাও বলেন। তিনি বলেন, আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না, তবে এক্ষেত্রে আমাদের দ্বিপাক্ষিক শুল্কমুক্ত সুবিধার নিতে হবে। এজন্য ট্রেড নেগোশিয়েশন করতে হবে। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে হবে। রপ্তানি পণ্যের মানোন্নয়ন করে যাতে ভালো দাম পাওয়া যায়, সে চেষ্টাও করতে হবে।