অনিয়ম ঢাঁকতে কৌশলী রাবি ভিসি, পদ বাঁচাতে চলছে চেষ্টা-তদবির

নিজস্ব প্রতিবেদক:

আপাদমস্তক যেন দুর্নীতিতে ভরে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, কোটেশন বাণিজ্য, অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়াসহ নানা দুর্নীতিতে ভরে গেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে এখন দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানেই যেন রুপান্তর নিয়েছে রাবি। যার নেতৃৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান। আর তাঁকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া এবং রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এ বারী ও উপ-রেজিস্ট্রার ও ভিসির স্ত্রীর ভাগ্নে সাখাওয়াত হোসেন টুটুল। এই তালিকা থেমে নেই এখানেই সবমিলিয়ে অন্তত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীও মিলেমিলে বিশ^বিদ্যালয়টিকে একেবারে আপাদমস্তক দূর্নীতে ভরে দিয়েছেন।

রাবির এই অনিয়ম-দুর্নীতিগুলো ঢেঁকেই স্বপদে বহাল থাকতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন ভিসি এম আব্দুস সোবহান। অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাঁকতে কখনো দুদককে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা আবার কখনো বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও (ইউজিসি) বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন ভিসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনেটিতেই তিনি সফল হতে পারবেন না বলেই এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে। কারণ দুটি প্রতিষ্ঠানই রাবির বর্তমান প্রশাসনের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে আপোষহীণ মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে বেকায়দায় পড়া ভিসি এখন গদি বাঁচাতে নানা চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দুদক সূত্র মতে, উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুস সোবহানসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চিঠি দেয় দুদক। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টারকে। চিঠিতে আগামী ২৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করতেও বলা হয়। কিন্তু শুরুতে সেসব তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে রাবি প্রশাসন। এরপর দুদক থেকে সরকারি কাজে অসহযোগিতার অভিযোগে ভিসি ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেওয়া হলে শেষ পর্যন্ত কিছু কাগজপত্র দেওয়া হয়। তবে চাহিদামতো তথ্য এখনো দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে দুদকের একাধিক সূত্র।

দুদকের ওই সূত্রটি জানায়, রাবির ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুস সোবহান ২০১৭ সালের মে মাসে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নানা অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেয়ে সানজানা সোবহান এবং মেয়ে জামাই এটিএম সাহেদ পারভেজকে চাকরি দেওয়াসহ রাবির বিভিন্ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রকল্পের টাকা হরিলুটের মেতে ওঠেন বলে অভিযোগ ওঠে। এসব নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অভিযোগ পাওয়ায় বিষয়গুলো নিয়ে তদন্তে নামে দুদক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ২০১৭ সালের মে মাস থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁর পূর্ণাঙ্গ তালিকা চায় দুদক। এর মধ্যে কতজন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণী দিতে বলা হয়েছে দুদককে। এই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন করে আইনের পরিবর্তন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭৩ তম এবং ৪৭৫ তম সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণীর ফটোকপিও চাওয়া হয়ছ। ওই সভাতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেখানেও নানা গড়মিল রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে রাবি প্রশাসনের দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটি। কিন্তু তাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি বলে অভিযোগ ওঠেছে ভিসির বিরুদ্ধে। এমনকি ইউজিসিকে গণশুনানীর আহ্বান জানিয়ে নিজে এবং তার সহযোগীদেরও সেই শুনানীতে অংশ নিতে দেননি ভিসি। এরপর তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এরই মধ্যে ভিসিরি সহযোগিতা ছাড়ায় তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কার্যক্রম শেষে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। একইসঙ্গে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সম্পদের উৎস অনুসন্ধানের সুপারিশও করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত সংবলিত ৩শ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) দাখিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের একাংশের শিক্ষক। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। কমিটি তাদের তদন্ত শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে সুপারিশসহ ৭৩৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়।

সম্পদের উৎস অনুসন্ধানের সুপারিশ:
উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়াসহ বেশকিছু শিক্ষকের নামে শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আড়ালে আর্থিক লেনদেনের মতো গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। পরে বিষয়টি তদন্ত করে কমিটির পক্ষ থেকে উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, অধ্যাপক আব্দুল হান্নান, সহযোগী অধ্যাপক শিবলী ইসলাম এবং উপাচার্যের আত্মীয় সাখাওয়াত হোসেন টুটুলের সম্পদের উৎস অনুসন্ধানের জন্য সুপারিশ করে কমিটি।

অন্যদিকে রাবির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দুর্নীতির পাহাড়ে ডুবতে বসা রাবির ভিসি শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে নানা চেষ্টা তদবির করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ওই তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনিসহ তাঁর সহযোগিদের বিরুদ্ধে যেন কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেটি রোধে রাজনৈতিকভাবেও চেষ্টা-তদবির শুরু করেছেন। আর এটি করতে আগামী রবিবারের মধ্যে তিনি যে কোনো সময় ঢাকায় রওনা দিতে পারনে বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এবার ভিসি আর রক্ষা পাবেন না। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে সরানো হতে পারে। পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাদ যাবেন না তাঁর সহযোগীরাও। তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে দুদকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, তদন্ত কমিটি সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দিয়েছে। তদন্তে রাবি প্রশাসনের বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর এসব বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেবে।

স/আর