‘অন্য বছরের চেয়ে এবারে জটিলতাগুলো অনেক বেশি’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

শিশু ফারজানা ফাইজার বয়স ১৪ মাস হয়েছে মাত্র। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে গত পাঁচ দিন ধরে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি আছে এই শিশুটি।

প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। চোখের সামনে নিজ সন্তানের এমন মুমূর্ষু অবস্থা দেখে অসহায় বোধ করছেন সামিয়া রহমান।

“আমার এই ছোট বাচ্চাটা অনেক কষ্ট পাচ্ছে। প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় রক্ত দিতে হচ্ছে। স্যালাইন চলছে। সারাদিন কান্নাকাটি করে। কিছু খায়না। ওর জন্য আমাদেরও কষ্টের শেষ নাই”।

তিনি অভিযোগ করছিলেন “এখন সিটি কর্পোরেশন যদি মশা ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করতো, আজকে আমাদেরকে এতো কষ্ট করতে হতো না। অন্যের গাফিলতির দায় আমরা কেন নেব?”

মিসেস রহমানের মতো এমন প্রশ্ন বেশিরভাগ ঢাকাবাসীর।

কেননা এবারের বর্ষা মৌসুমে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অন্য যে কোন বারের চাইতে অনেক বেশি।

হাসপাতালে ভর্তি রেকর্ড সংখ্যক রোগী:

সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৪২৪৭জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

এরমধ্যে শুধু জুন থেকে ১২ই জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৩৬৪৭ জন।

তবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শোয়েব মোমেন মজুমদার।

“প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা আসছে। এবারের সংখ্যাটা অনেক বেশি। বলা যায় যে, গত বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুন বেশি। এমনও রোগী আছেন যারা দ্বিতীয়বারের মতো, তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়ে আসছেন। তাদের অবস্থা বেশ জটিল। আর এবারের ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে মূলত তিন নম্বর প্রজাতির মশাগুলো। যেগুলোর কারণে রোগের জটিলতা অনেক বেড়েছে।”

বেড়েছে ডেঙ্গু রোগের জটিলতা:

সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যা তিন জন বলা হলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রোগ তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-আইইডিসিআর এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১১ জন।

সব মিলিয়ে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চাইতে উদ্বেগজনক এবং বিগত যেকোনো বছরের চাইতে এই জটিলতার দিকগুলো অনেক বেড়েছে বলে জানান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মোমেন মজুমদার।

“আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর হতো, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতো। তবে এবারে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অন্যরকম। যেমন কেউ তীব্র পেটব্যথা নিয়ে আসছেন, কারও হার্টের সমস্যা বেড়েছে। কারও ব্রেনে অ্যাফেক্ট ফেলেছে। অন্যান্য বছরের চাইতে এবারে এই জটিলতাগুলো অনেক বেশি।”

কী বলছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র:

এদিকে মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন এতদিন ধরে যে ওষুধ ব্যবহার করছে সেটা আর আগের মতো কাজ করছেনা বলে জানিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র-সিডিসি এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবি ।

মশা এখন আরও শক্তিশালী বলে তাদের পৃথক দুটি গবেষণায় উঠে আসে।

এমন অবস্থায় মশার ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়ে এই সপ্তাহে একটি সভার ডাক দেয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন।

তবে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নিধনে নাগরিক সচেতনতাই সবচেয়ে জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

“ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যে শুধু ঢাকা বা বাংলাদেশেই বেশি তা নয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিল্লি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহর, সিঙ্গাপুর সিটি, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সের মতো জায়গায় এবার রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এসবের পেছনে আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটাই ঘুরে ফিরে আসছে।”

তবে কারণ যাই হোক দ্রুততম সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তিন ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান মেয়র সাইদ খোকন।

প্রথমত ঢাকা দক্ষিণের ৫৭টি ওয়ার্ডে ৬৭টি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

তারা বর্ষা মৌসুমের সর্দি কাশির মতো সমস্যার প্রাথমিক ও বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের তাদের অসুস্থতার মাত্রা বুঝে পরামর্শ দিচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য পরিচ্ছন্নতা বিভাগের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছে। তারা সামনের সপ্তাহে ঢাকা দক্ষিণের আওতাভুক্ত ভবনগুলোয় অভিযান পরিচালনা করবে বলে জানান মেয়র সাইদ খোকন।

তিনি বলেন, “যদি কোন ভবনে স্বচ্ছ জমানো পানি থেকে যেগুলোয় ডেঙ্গু মশার লার্ভা থাকে। সেগুলোকে আমাদের টিম ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। কেননা এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে থাকে। বাইরের নোংরা পানিতে থাকেনা। তাই জনসচেতনতা হল এডিস মশা নির্মূলের সবচেয়ে বড় শক্তি।”

তৃতীয়ত, মশা মারার উপযোগী নতুন ওষুধ কিনতে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দফতর অধিদফতরের সঙ্গে সামনের সপ্তাহে একটি বৈঠক করার কথা জানান তিনি।

মূলত ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যে কি ধরণের ওষুধ আমদানি করা যাবে। কেননা এসব ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়।

সাইদ খোকন বলেন, “আমরা চাইলেই যখন তখন যেখানে সেখানে ওষুধ ছেটাতে পারিনা। এর সাথে আমাদের স্বাস্থ্য পরিবেশসহ আরও নানা বিষয় জড়িত আছে। আমরা এটা নিয়ে কথা বলবো। তারপর অনুমোদন নেয়ার ভিত্তিতে ওষুধ কিনে ছেটানোর ব্যবস্থা করা হবে।”

বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে এবার ২০০০ সালের পর সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।