‘অন্তত লাশটা পেতে চাই’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

পিতা জানেন না সন্তান বেঁচে আছে কি মরে গেছে! স্ত্রী জানেন না তাঁর স্বামী মৃত না জীবিত! এভাবে কারোরই দমবন্ধ অপেক্ষার প্রহর ফুরাতে চাইছে না যেন। স্বামীর জীবিত অথবা মৃতদেহের জন্য অপেক্ষায় বাকরুদ্ধ স্ত্রী। যুবক সন্তানের অপেক্ষায় জলচোখে বয়সের ভারে ন্যুব্জ পিতা। ছেলের পথ চেয়ে বুকফাটা আর্তনাদে নির্ঘুম চার রাত পার করেছেন জন্মধাত্রী মা। এরই মধ্যে কেউ শোনাচ্ছে আশার বাণী। কেউবা হতাশার। আশা-নিরাশার এই দোলাচলে চার দিন কেটে গেছে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মুণ্ডুমালা, দাসমরিচ ও চণ্ডিপুর গ্রামের ১৭টি পরিবারের সদস্যদের। গত সোমবার গভীর রাতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চরঝাপটা এলাকায় মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির দুর্ঘটনায় তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছে। এরই মধ্যে চার দিন পার হলেও নিখোঁজদের সন্ধান না মেলায় পরিবারগুলোর মধ্যে চরম হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে।

গতকাল শুক্রবার স্বজনহারাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজদের নিয়েই চলছে আলোচনা। স্বজনহারা এবং এলাকাগুলোর সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রধান আলোচনা এটি। নিখোঁজদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় এলাকার সব মানুষ।

যে স্বজনরা গত কয়েক দিন ধরে নিখোঁজদের জীবিত ফেরত পেতে পাগলপ্রায় ছিল। গতকাল দেখা গেছে, চার দিনের টানা অপেক্ষায় তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত। তারা বলছে, জীবিত না হোক, প্রিয়জনের মরদেহটা অন্তত যেন ফেরত পায় এই আকুতি সরকারের কাছে।

গতকাল দাসমরিচ গ্রামের একই পরিবারের নিখোঁজ চারজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। কয়েকজন বয়স্ক নারী ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না করছে। প্রতিবেশী মহিলারা তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পরিবারের গৃহকর্তী হনুফা বেগম জানেন না তাঁর স্বামী মোশাররফ হোসেন, দুই ছেলে আলিফ ও মোস্তফা এবং ভাই রুহুল আমিন জীবিত আছে কি না। চার দিন ধরে বিরামহীন কান্নায় তাঁর চোখের জলও যেন ফুরিয়ে গেছে।

নিখোঁজ তুহিনের (২৫) বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাঁর নববিবাহিত স্ত্রী মুসলিমা যাকেই দেখছেন, তার কাছেই অনুরোধ রেখে বলছেন, ‘আমার স্বামীকে জীবিত না হোক, অন্তত মৃত দেহটাই ফেরত দাও।’ বিলাপ করতে করতে মুসলিমা কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন।

তুহিনের বাবা ছায়দার আলী বলেন, ‘অনেকে বলে আমার ছেলে বেঁচে আছে। আবার কেউ বলে মারা গেছে, লাশ আসতেছে। কিছুক্ষণ পর আবার শোনা যায় খুঁজেই পাওয়া যায়নি।’ এ সময় তিনি ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, ‘ছেলের লাশটা অন্তত ফেরত চাই।’

দুই বছর ও চার বছরের দুই শিশুকন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন রত্না আক্তার। তাঁর হৃদয়বিদারক বিলাপে চোখের জল মুছতে থাকে বাড়িতে উপস্থিত অন্যরাও। কেউ কেউ তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই তাঁর বিলাপ থামাতে পারেনি। অসীম এক শূন্যতা নিয়ে তাঁর একটাই দাবি—অন্তত স্বামীর লাশটা চাই।

খানমরিচ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছাদুর রহমান  জানান, উদ্ধার অভিযানে এ পর্যন্ত নিখোঁজদের কারো সন্ধান মেলেনি। ভাঙ্গুড়ার ইউএনও, পাবনার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান  জানান, মেঘনায় নিখোঁজদের অনুসন্ধান অভিযান অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।