অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে চোরাই স্মার্টফোন বিক্রি!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ খুলে বা গ্রুপ তৈরি করেও চোরাই স্মার্টফোন বা বিভিন্ন পণ্য বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তবে বেশি অভিযোগ ক্লাসিফায়েড (শ্রেণিভিত্তিক) মার্কেটপ্লেসগুলোর বিরুদ্ধে। এসব মার্কেটপ্লেসে রীতিমতো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে এসব মার্কেটপ্লেসে বিক্রি হওয়া চোরাই মোবাইল ফোনসহ চুরি যাওয়া অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করেছেন। বিক্রয় ডটকম নামের একটি মার্কেটপ্লেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ওয়েবসাইটটিতে চোরাই স্মার্টফোন বিক্রি হয়। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিক্রয় ডটকমে বিক্রি হওয়া এ ধরনের একটি চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছেন। যদিও বিক্রয় ডটকম কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এ ধরনের কোনও অভিযোগ পাননি।

বেশ কিছুদিন ধরে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রির ঘটনা ঘটছে। একটি চক্র এসব চোরাই মোবাইল সেট বিক্রির জন্য অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একজন ব্যবহারকারীর অভিযোগের ভিত্তিতে এমন একটি চোরাই মোবাইল সেট উদ্ধারের পর এসব তথ্য জানতে পেরেছে পুলিশের এই তদন্ত সংস্থা।

পিবিআই’র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ মার্চ একটি চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই ফোনটি বিক্রি করা হয়েছিল। মোবাইল সেটটি উদ্ধারের পর ২৮ মার্চ এর মূল মালিকের কাছে তা হস্তান্তর করা হয়।’ তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা যায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

জানা যায়, গত ১২ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার গণভবনের সামনে থেকে ইশতিয়াক ইমন নামের একজনের মোবাইল ফোন হারিয়ে যায়। শাওমি নোট ৪ মডেলের ওই হ্যান্ডসেট হারানোর পর ১৫ মার্চ শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। ওই জিডির ভিত্তিতেই তদন্ত করে ২৭ মার্চ মোবাইল সেটটি উদ্ধার করে পিবিআই।

পিবিআই জানিয়েছে, একটি জিডির ভিত্তিতে হারানো মোবাইল সেটের সন্ধান শুরু হয়। সেটের আইএমইআই নম্বরের সহায়তায় হারিয়ে যাওয়া সেটের ব্যবহারকারীর লোকেশন ও নম্বরের কল ডিটেল রেকর্ড (সিডিআর) বের করা হয়। পরে ব্যবহারকারীকে জানানো হয়, তার কেনা মোবাইলটি চোরাই।

এএসপি আতিকুর রহমান বলেন, ‘ওই সেটটি যিনি পরে কিনেছিলেন তাকে চোরাই সেটের বিষয়ে জানানোর পরই তিনি তা পিবিআই সদর দফতরে এসে ফেরত দিয়ে যান। বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দেখে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ফোনটি কেনেন তিনি। কিন্তু তার জানা ছিল না এটি চোরাই সেট। এ প্রসঙ্গে তাকে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।’

অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রি করে আসা চক্রকে গ্রেফতার করতে পিবিআই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান এএসপি আতিকুর।

ভুক্তভোগী ইশতিয়াক ইমন পেশায় গণমাধ্যমকর্মী। তিনি বলেন, ‘১২ মার্চ আমার মোবাইল ফোনটি হারিয়ে গেলে ১৫ মার্চ একটি জিডি করি। পরে এর একটি কপি নিয়ে পিবিআইয়ে যোগাযোগ করি। পরে পিবিআই ফোনটি উদ্ধার করে আমাকে জানায়। পরে গিয়ে পিবিআই সদর দফতর থেকে সেটটি নিয়ে এসেছি।’

বিক্রয় ডটকমের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের প্রধান ঈশিতা শারমিন বলেন, ‘আমরা সাধারণত এ ধরনের অভিযোগ পাই না। আর যে নির্দিষ্ট অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সেই অভিযোগও আমাদের কাছে আসেনি।’

তবে ঈশিতা শারমিন উল্লেখ করেন, অনেক আগে তারা এ ধরনের অভিযোগ পেতেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তারা (বিক্রয় ডটকম) বিজ্ঞাপন প্রকাশে স্বচ্ছতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তার দাবি, তাদের একটি বড় টিম রয়েছে যাদের কাজ হলো যেকোনও ধরনের বিজ্ঞাপন চেক করে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই তবে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। কয়েকটি পদ্ধতিতে তারা কাজটি করে থাকেন বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, মার্কেটপ্লেস রয়েছে দুই ধরনের। একটি ই-কমার্সভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস। অন্যটি ক্লাসিফায়েড (শ্রেণিভিত্তিক) মার্কেটপ্লেস। ক্লাসিফায়েড মার্কেটপ্লেসের বিরুদ্ধেই যত অভিযোগ। এই মার্কেটপ্লেসে সরাসরি বিনামূল্যে ও টাকার বিনিময়ে স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা যায়। যদিও ক্লাসিফায়েড মার্কেটপ্লেস কর্তৃপক্ষ সেই বিজ্ঞাপনকে অনুমোদন দিলেই তা প্রকাশ হয়। চোরাকারবারিরা এই সুযোগই নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগেও (সিআইডি)বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে বলে জানান সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিক্রয় ডটকমের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ছিল বেশি। অভিযোগ ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়া এখানেই ডটকমের বিরুদ্ধেও। এছাড়া অনেক ভুঁইফোড় অনলাইনেও চোরাই স্মার্টফোন বিক্রির অভিযোগ তারা পেয়েছেন বলেন জানান তিনি। সঠিক নাম-ঠিকানা না থাকায় অনেক সময় ওয়েবসাইটগুলো কারা পরিচালনা করে তা খুঁজে না পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ই-কমার্সভিত্তিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমাদেরটি মার্কেটপ্লেস, তবে আমাদের ওয়েবসাইটে নতুন স্মার্টফোন ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয়। সরাসরি মার্চেন্টরা (ব্যবসায়ীরা) আমাদেরকে পণ্য দিয়ে থাকেন। এরপর তা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।’

আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জানান, ইন্টারনেটে কিছু ক্লাসিফায়েড ওয়েবসাইট আছে যেখানে স্মার্টফোনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি হয়। কয়েকটির বিরুদ্ধে চোরাই স্মার্টফোনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তার ভাষ্য, ‘ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করেও চোরাই জিনিসপত্র বিক্রির অভিযোগ বেশ পুরনো। একেক সময় একেক ধরনের গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হয়। এখান থেকে পণ্য কিনে প্রতারিত হলে বা কোনও ধরনের সমস্যা হলে ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সরব হন। তখন মিডিয়ায় নিউজ ছাপা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরে পুরনো নিয়মে এ ধরনের কাজ আবারও চলতে থাকে।’

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, ‘ই-কমার্সভিত্তিক মার্কেটপ্লেসে চোরাই পণ্য বিক্রি হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ক্লাসিফায়েড (শ্রেণিভিত্তিক) মার্কেটপ্লেসে চোরাই পণ্য বিশেষ করে স্মার্টফোন ও মোটরসাইকেল বিক্রির ঘটনার কথা বিভিন্ন সময়ে আমরা জানতে পেরেছি। দেশে বিক্রয় ডটকম, ক্লিকবিডি, এখানেই ডটকমসহ (এখন বন্ধ) ১৭-১৮টির মতো মার্কেটপ্লেস রয়েছে। এরমধ্যে এখন দাপিয়ে ব্যবসা করছে বিক্রয় ডটকম। বিভিন্ন সময় ফেসবুকে চোরাই পণ্য বিক্রির অভিযোগ নিয়ে পোস্ট দেখেছি।’

ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি মনে করেন, মার্কেটপ্লেস নীতিমালার অভাবেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বারবার ঘটছে। তার কথায়, ‘পৃথিবীর অনেক দেশেই নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালা থাকলে এ ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে না কেউ।’ এক্ষেত্রে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সব ধরনের সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে।’