মোঃ ওসমান গনি
বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ জনগন গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের মানুষদের প্রধান জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হলো কৃষি কাজ। কৃষি কাজের উপর নিভর করে গ্রামের জনগনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। গ্রামের জনগনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একমাত্র পথই হলো কৃষি কাজ। প্রাচীনকাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া পেশা হলো কৃষি কাজ। এই কৃষি কাজ করে গ্রামের জনগন তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের চেষ্টা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু নানা প্রকার প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি,জলোচ্ছ্বাস মহামায়ী তাদের মুখের অন্নকে ধ্বংস করে। তারপরও বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে কৃষকেরা। চিরাচিয়েত প্রথা অনুযায়ী কৃষকদের সন্তানেরা তাদের বাবার পেশাগ্রহন করে জীবিকা নির্ভর করে। কৃষকদের সন্তানেরা সে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা দীক্ষা লাভ করবে তা তাদের নিত্যদিনের অভাবের স্বপ্নই থেকে যায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হয়। যেমন- অন্ন, বস্তু, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন। এই সমস্ত মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা একটি মৌলিক চাহিদা।
কারন যে জাতি শিক্ষায় যত উন্নত সে জাতি সব দিক দিয়ে তত উন্নত। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ৬ ফেব্র“য়ারী সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ হয়। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারী সারা দেশে সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালুর পর থেকে গ্রামের জনগন তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে সচেতন হয়। সরকার প্রতিবছর ১ জানুয়ারী বিনামূল্যে বই সরবরাহ করার ফলে গ্রামের জনগনের মধ্যে শিক্ষা গ্রহন করার জন্য আগ্রহ বেড়ে যায়। এছাড়া সরকার বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করার ফলে গ্রামের দরিদ্র্য পরিবারের শিশুরা খুব সহজে বিদ্যালয়ে যেতে পারছে। তার পরও গ্রামের শিক্ষার্থীরা নানাবিধ সমস্যার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার কারণঃ-
গ্রামের পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণও অসচেতন নানা ধরনের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির কারনে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাইনা।
গ্রামের অনেক পিতা-মাত ও অভিভাবকগণ অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত হওয়ার জন্য তারা তাদের সন্তানদের যে শিক্ষিত করে গড়ে তোলতে হবে তারা সে ধরনের তাগিদ অনুভব করে না।
গ্রামের অনেক পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণকে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। তাই তাদের কাছে শিক্ষা গ্রহন অপেক্ষা বেঁচে থাকাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। এর জন্য দরিদ্র কৃষকদের সন্তানেরা তাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের সাথে কাজ করে।
গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা পুষ্টিহীনতা জনিত সমস্যার কারনে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। এর জন্য শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীরা ভঙ্গুর পরিবার থেকে বিদ্যালয়ে আসে। ভঙ্গুর পরিবারের নানাবিধ সমস্যার কারনে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্টের অভাবের জন্য অর্থাৎ যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যার জন্য শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার সমস্যার জন্য লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করার জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধার অভাব যেমন, বিদ্যুতের সমস্যার জন্য অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণী কার্যক্রম সঠিক ভাবে পরিচালনা করার জন্য অর্থাৎ শিখন শেখানো কার্যক্রম সহজ সরল সুন্দর ও আকর্ষনীয় পরিচালনার জন্য বিষয় ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব। বিষয় ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকদের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু বুঝতে না পেরে দিনে দিনে লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর অভাব। এর কারনে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সম্মত আধুনিক স্যানিটেশনের পাণীয় জলের অভাব। স্যানিটেশন, পাণীয় ও জলের অভাব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসতে চাই না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা দিনে দিনে লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক বিকাশে সাধনের জন্য খেলাধুলার মাঠ নেই। খেলাধুলার মাঠে অভাবে আনেক শিক্ষার্থী খেলাধুলা করতে পারে না। লেখাপড়া থেকে পিছিয়ে পড়ার একটি একটি কারন।
শিক্ষার্থীদের সৃজশীলতার বিকাশ সাধনের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব। গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঠিকমত সাংস্কৃতিক চর্চা হয়। না।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান দানের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের অভাব।
শিক্ষার্থীদের বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাদানের জন্য শিখন শেখানো কার্যবলীকে সহজ, সুন্দর,চিওাকর্ষক, আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় কার্যকর করার জন্য গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষা উপকরণের অভাব।
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর পরিবেশ অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় নয় এর ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন পরিবেশে এসে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আকর্ষণীয় করে না।
শ্রেণি পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিকতার সহিত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে না। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকের পঠিতব্য বিষয়বস্তু সহজে আয়ত্ব করতে পারে না। বিষয় বস্তু যখন আয়ত্ব করতে পারে না তখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় থেকে পিছিয়ে পড়ে।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার প্রতিকারঃ-
গ্রামের অনেক পিতা-মাত ও অভিভাবকেরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকাংশে অসচেতন। এই অসচেতন পিতা-মাতা ও অভভাবকদের শিক্ষকা প্রতিষ্ঠান গুলোতে মা ও অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহনের উপকারিতা সর্ম্পকে সচেতন করা যায়। তাহলে পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাবে। এবং লেখাপড়ার ব্যাপারে সচেতন হবে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের পিতা মাতা ও অভিভাবকগন অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত। তাই তাদের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা মূলক পথ নাটক দেখানো যেতে পারে। শিক্ষা গ্রহন না করলে তাদের মধ্যে যে আধুনিক ধ্যান ধারণা চিন্তা চেতনার জন্ম নিবে না তা তাদের বুঝতে হবে। এবং শিক্ষা গ্রহণ করলে তাদের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য , শিক্ষা স্বাস্থ্য, চাকুরী প্রভূতির উন্নয়ন হবে তা বুঝাতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবন যাত্রার সার্বিক মান উন্নয়ন হবে।
গ্রামের অধিকাংশ পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে তাদের সন্তানদের যদি উপবৃত্তি প্রদান করা হয় মিড ডে মিল চালুকরা হয় বিদ্যালয়ে তাহলে দারিদ্র পরিবার গুলোর পিতা-মাতা ও অভিভাবগণ তাদের সন্তাদের বিদ্যালয়ে পাঠাবে । গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা পুষ্ঠিহীনতার শিকার। কোন খাবারে কোন পুষ্টিগুণ তা তাদের জানা নেই। তাই মায়েদের কোন খাবারে কোন ধরনের পুষ্টিগুণ আছে তা তাদের জানতে হবে, যাতে তাদের সন্তানদের পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ খাবার দেয়। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কৃমিজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার বিনামূল্যে কৃমিনাশক বড়ি প্রদান করছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের দেশের দারিদ্রর হার সর্ব নিম্নপর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য বদ্ধ পরিকর। বর্তমান সরকার আমাদের দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে ঘোষণা করেছেন।
গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী ভঙ্গুর পরিবার থেকে বিদ্যালয়ে আসে। শিক্ষার্র্থীর পিতা বা মাতা অল্প বয়সে মারা যায়। আবার কোন কোন শিক্ষার্থীর পিতা মা তার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। কোন কোন পরিবারে পিতা-মাতার মধ্যে প্রায় ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকে। এই রকম নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া করে। এই সমস্যা সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা সঠিক মত লেখা পড়া করার মতো পরিবেশ পাবে এবং লেখা পড়ায় মনোযোগ পারবে।
গ্রামের রাস্তা-ঘাট সেতু ও কালভেটের অবস্থা তেমন ভালো না। এর জন্য অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারে না। বিশেষ করে বিল, হাওড়, বাওড়, নদী ও পাহাড়ী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা । এই সমস্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করলে পিতা-মাতা ও অভিভাকগণ তাঁদের সন্তানদের অতি সহজেই বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারবে। কারণ গ্রাম এলাকায় বর্ষাকালে বন্যার রাস্তাঘাট ডুবে যায়। তাই শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক পিতা-মাতাও অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাই না। সরকারকে গ্রামীণ অবকাঠামোর বিশেষ করে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করার জন্য বেশি করে বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। তাহলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসার সমস্যা দুর হবে।
সরকার ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেই আলোকে কাজ করে যাচ্ছে। এটি একটি প্রশংসীয় উদ্যোগ। গ্রামের শিক্ষার্থীদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হবে। কারণ বিদ্যুতের অভাবে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ঠিকমত লেখাপড়া করতে পারে না। তার উপর যে সমস্ত গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে সেখানে ঘনঘন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘœ ঘটায়। এতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া সমস্যা হয়। তাই শিক্ষার্থীদের প্রতি লক্ষ্য রেখে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা আশু প্রয়োজন।
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে। বিষয় ভিত্তক যোগ্যতা ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত। বিশেষ করে সরকার আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথোপযোগী বিজ্ঞানসম্মত সিলেবাস প্রায়ন করেছে। কিন্তু বর্তমানে যে অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব। বর্তমান সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে গণিত ও ইংরেজি সিলেবাস তৈরি করেছে আমি মনে করি তা অনেক শিক্ষক গণিত ও ইংরেজি বিষয় পড়ানোর মত দক্ষ নয়। এছাড়া সরকার ্রপাথমিক বিদ্যালয় থেকে সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে সবাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করছে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র অনেক শিক্ষক বুঝে না। তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিভাবে বুঝতে পারবে। সরকার যেহেতু শিক্ষার পরবর্তী স্তরে অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করছে সেহেতু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর মাধ্যমকি ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিশেষ করে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি, গণিত, পদার্থ, ও রসায়ন বিষয়ের শিক্ষকের অভাব আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিষয় ভিত্তিক দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। তার উপর গ্রামের অধিকাংশ পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণ দরিদ্র। তাই তারা তাদের সন্তানদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানোর মত টাকা পয়সা দিতে পারে না। তাই বিষয়ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের মত বিষয়গুলোতে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এই সকল বিষয়গুলোতে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা জরুরী। দেরীতে হলেও বর্তমান সরকার বিষয় ভিত্তিক দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দানের জন্য ঘঞজঈঅ এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ বন্ধ করেছে। এটা বর্তমান সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিষয় ভিত্তিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক পাবে। এছাড়া শিক্ষকদের যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা হলে আধুনিক ধ্যান ধারণা সম্পর্কিত বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আইসিটি প্রশিক্ষণ এবং মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক ক্লাস রুম চালু করতে হবে।
গ্রামের শিক্ষার্থীদের সঠিক ভাবে শিক্ষা দানের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন করতে করতে হবে। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামোর অভাব। ভৌত অবকাঠামোর অভাব জনিত কারণে শিক্ষার্থীদের শ্রেনী কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা শিখন শেখানোর ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও কারিগরি কলেজের ভৌত অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন করেছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানও উন্নয়ন হবে।
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন পাণীয় জলের অনেক সমস্যা। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বয়:সন্ধিতে পৌছায়। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেক শারীরিক,মানসিক ও আচরনের পরিবর্তন হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। কিন্তু বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সঠিক মত স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন পাণীয় জল পায় না। তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে চাই না। তাই বয়:সন্ধিকালীন সময়ে ও পরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিক স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ সাধনের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে খেলাধুলার মাঠ অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই। শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশের জন্য অবশ্যই প্রতিটি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ থাকা প্রয়োজন। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে অন্তেক্রিয়া করে এর ফলে একে অপরের সাথে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠে। যা শিক্ষাথীদের পরবর্তী জীবনে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সাংস্কৃতিক চর্চা হয় না বললেই চলে। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক চর্চা হয় না। সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবে শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা, মুক্তিযুদ্ধের ইহিতাস প্রভৃতি সঠিক মত জানতে পারে না। আমাদের দেশের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস শিক্ষার্থীরা যদি জানতে পারে তাহলে তারা বিপদ গামী হবে না। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং নিজ দেশকে ভালোবাসতে পারবে। তাই প্রতিষ্ঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই সাংস্কৃতিক চর্চা করা প্রয়োজন।
গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে লাইব্রেরী ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের খুব অভাব। শিক্ষার্থীদের বিষয় জ্ঞানে দক্ষ করতে হলে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে গ্রামের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে লাইব্রেরীও গবেষণাগার নেই। আর এর ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক জ্ঞান লাভে ব্যর্থ হয়। একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই লাইব্রেরী ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার থাকতে হবে। তাহলেই সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিনত হবে।
শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো কার্যক্রমে অবশ্যই শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণের খুবই অভাব। শ্রেনি কার্যক্রমে বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের বুঝাতে গেলে বিষয়বস্তু উপযোগী শিক্ষা উপকরণ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। বিষয়বস্তু উপযোগী শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করলে শিখন শেখানো কার্যক্রমী সহজ সরল, সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়। পাঠের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীরা খুব কম সময়ে সঠিক ও সুন্দর ভাবে বুঝতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু দীর্ঘ সময় স্মরণে থাকে। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই শিক্ষা উপকরণ থাকতে হবে এবং শিক্ষা উপকরণ শ্রেণি কার্যক্রমে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ উপযোগী হতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করবে। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ না করে তাহলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় মুখী হবে না। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষার্থীদের উপযোগী হতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করবে সেই রকম ভাবে বিদ্যালয়ে পরিবেশ হবে গড়ে তোলতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে শিশু বান্ধব ও শিক্ষা বান্ধব।
গ্রামের অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক না। কোন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক না হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষকের পঠিতব্য বিষয় মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করবে না। অর্থাৎ পঠিতব্য বিষয় শিক্ষার্থীরা আয়ত্ব করতে আনন্দ পাবে না। এতে সেই শিক্ষকের শিখন শেখানো কার্যাবলী পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। কাজেই একজন যোগ্য, দক্ষ ও আদর্শ শিক্ষক হতে হলে শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে এবং আন্তরিকতার সহিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমের শিক্ষার্থীদের বয়স, রুচি ও অভ্যাস অনুযায়ী আচরণ করতে হবে। তাহলে শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা সাদরে গ্রহণ করবে এবং পঠিতব্য বিষয় সুন্দর ভাবে নিবে।
গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাড়ির পরিবেশ থেকে বিদ্যালয়ে নতুন পরিবেশে এসে খাপ খাওয়াতে পারে না। বাড়ির পরিবেশ থেকে বিদ্যালয়ের নুতন পরিবেশে শিক্ষার্থীরা যখন কোন মতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না । তখন শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। আর শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করার জন্য সরকার শিশু শ্রেণি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা চালু করেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শিশু শ্রেণিতে থেকে বিদ্যালয়ে নতুন পরিবেশে অভিযোজন করা শিক্ষা লাভ করতে এবং শিশুদের শ্রেণি কক্ষ অত্যন্ত মনোরম ও আকষণীয় করা হবে। এর ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ে প্রতি আকর্ষণ লাভ করবে তাদের স্কুল ভীতি দূর হবে। কাজেই শিক্ষার্থীদের বাড়ির পরিবেশ থেকে বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর ও আকর্ষনীয় করা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষার্থীরা স্কুলভীতি দূর করে বিদ্যালয়ের প্রতি যেন আকর্ষন বোধ করে।
আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষার হালচাল নিয়ে শিক্ষাবিদরা নানা মতামত প্রকাশ করছে। কিন্তু শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ফলাফল নিয়ে আলোচনা তর্ক বিতর্ক না করে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের ও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে একটু লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তারা নিত্য দিনের মৌলিক চাহিদা সন্তানদের দিতে হিমসিম খাচ্ছে। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ নেই। আর সাংস্কৃতিক চর্চার অভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু ও সঠিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষার্থীদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলতে হলে সঠিক ভাবে শিক্ষাদান করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলতে পারলে বাংলাদেশ সঠিক পথে পরিচালিত হবে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার সঠিক কারণ চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারলে আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
লেখকঃ
সহকারী শিক্ষক
মচমইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়
বাগমারা, রাজশাহী।
৮/১২/১৬