সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
গতকাল, ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি রোবটচালিত চীনা মহাকাশযান চাং’ই-৪ (Chang’e 4) চাঁদের দূরবর্তী অংশের (Far Side) মাটিতে পা রেখেছে। দ্য চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (CNSA) এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। মহাকাশযানটি দক্ষিণ মেরুর এইটকেন বেসিনে (Aitken Basin) অবতরণ করেছে। চাঁদের বুকে এটিই সবচেয়ে বড়, গভীর এবং পুরনো খাদ। ধারণা করা হয়, চাঁদ গঠিত হওয়ার সময় ভয়াবহ কোনো সংঘর্ষের ফলে খাদটি তৈরি হয়েছিল।
পৃথিবী থেকে সবসময় চাঁদের এক পৃষ্ঠ দেখা যায়, একে নিকটবর্তী অংশ (Near Side) বলা হয়। এর কারণ হলো টাইডাল লকিং। চাঁদ যে বেগে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসে, সেই একই বেগে সে তার নিজ অক্ষের উপরেও ঘোরে। ফলে পৃথিবী থেকে অপরপাশটি কখনোই দেখা যায় না। একে চাঁদের দূরবর্তী অংশ (Far Side) বলা হয় (যদিও সূর্যের আলো পৌঁছায় ঠিকই, তারপরও পৃথিবীর হিসেবে বলা হয়)। একারণে এর আগে সেখানে কোনো মহাকাশযান পাঠানোও হয়নি।
চাঁদের বুকে যারা পা রেখেছিলেন, তারাও চাঁদের পৃথিবীমুখী অংশে নেমেছেন, তারপর ওপাশে গিয়ে সেই অংশগুলো মানচিত্রে যুক্ত করেছেন। অর্থাৎ চাঁদের উল্টোপাশে মানুষের পাঠানো প্রথম মহাকাশযানও এই চাং’ই-৪।
মহাকাশযানটির নামকরণ করা হয়েছে চীনা চন্দ্রদেবী চাং’ই এর নামানুসারে। এর আগে চাং’ই-১ এবং ২ চাঁদের কাছ ঘেঁষে ঘুরে এসেছিল এবং ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাং’ই-৩ পা রেখেছিল চাঁদের বুকে। তারই উত্তরসূরী হিসেবে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর চাং’ই-৪ চাঁদের উল্টোপাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। চাং’ই-৪ অবতরণের খবর প্রথম টুইট করে সরকার পরিচালিত সংবাদমাধ্যম চায়না ডেইলিএবং সিজিটিএন (CGTN)। তবে এর কিছুক্ষণ পরেই তারা টুইটগুলো ডিলিট করে দেয়। ফলে খবরের সত্যতা নিয়ে সবার মাঝেই সংশয় তৈরি হয়। চায়না ডেইলি টুইট করে বলেছিল,
চীনা মহাকাশযান চাং’ই-৪ চাঁদের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেছে, যা মানুষের চন্দ্র অনুসন্ধান গবেষণায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।
দুই ঘন্টা পরে আনুষ্ঠানিকভাবে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে সরকারি সংবাদমাধ্যম CCTV। তাদের বিবৃতি থেকে জানা যায়, চাং’ই-৪ বেইজিং সময় অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করেছে। কম্যুনিস্ট পার্টির সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-ও খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
ইতোমধ্যে মহাকাশযানটি চাঁদের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের ছবি পাঠানো শুরু করেছে। এই ছবিগুলোই চাঁদের উল্টোপাশের সবচেয়ে ক্লোজ শট। এরকম একটি ছবি টুইট করেছে CCTV এর ইংরেজি ভার্সন। চাং’ই-৪কে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হলো চাঁদের উল্টোপাশের পৃষ্ঠতলের ব্যাপারে এবং চাঁদের বিভিন্ন খনিজ পদার্থ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা।
চাং’ই-৩ যখন ২০১৩ সালে চাঁদে নেমেছিল, তখন সে চাঁদের বুকে প্রচুর ইলমেনাইট (Ilmenite) সমৃদ্ধ নতুন এক ধরনের ব্যাসাল্টিক পাথর আবিষ্কার করে। যেহেতু চাং’ই-৪ এইটকেন বেসিনে অবতরণ করেছে এবং বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, এ খাদটি চাঁদ গঠিত হওয়ার সময় তৈরি হয়েছে। তাই আশা করা যাচ্ছে, মহাকাশযানটি চাঁদ কিভাবে তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে নতুন এবং উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য দিতে পারবে। বিবিসির তথ্যানুযায়ী,
একটি ‘মিনি বায়োস্ফেয়ার’ বা জীবমন্ডল তৈরি করে সেখানে আলু ফলানো কিংবা রেশমগুটি জন্মানো যায় কিনা, তা নিয়েও পরীক্ষা চালাবে চীন।
চাঁদের উল্টোপাশে মহাকাশযান পাঠানো নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল যোগাযোগ। কারণ উল্টোপাশ থেকে যে সিগন্যাল পাঠানো হবে, চাঁদ নিজেই সেটিকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে বাধা দিবে। একইভাবে পৃথিবী থেকে পাঠানো সিগন্যালও সেখানে পৌঁছাবে না। সেজন্য রিলে স্যাটেলাইট দরকার, যেটি চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝখানের এমন কোন অংশে অবস্থান নেবে, যাতে দুই জায়গাতেই সিগন্যাল পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারে। সেজন্য ২০১৮ সালের ২০ মে চিন কোয়েকিয়াও নামে একটি রিলে স্টেশন পাঠায়।
চীনা ‘কোয়েকিয়াও’ শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘ম্যাগপাই ব্রিজ’। এটি এসেছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিয়ে প্রচলিত একটি চৈনিক উপকথা থেকে। সেই গল্প অনুযায়ী, আলতেয়ার এবং ভেগা একে অন্যকে অসম্ভব ভালোবাসে, কিন্তু তাদের দেখা করার কোনো উপায় নেই। কেবল বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে যখন একদল ম্যাগপাই পাখি মিলে আকাশের বুকে সেতু তৈরি করে, শুধুমাত্র সেদিন তারা পরষ্পরকে দেখতে পায় এবং তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
যেহেতু পৃথিবী আর চাঁদের উল্টোপাশের অংশটির মাঝে কোয়েকিয়াও সেরকম একটি যোগাযোগ সেতুই তৈরি করবে, সেজন্যই এমন নামকরণ। ৪২৫ কেজি ওজনের এই স্যাটেলাইটটি বর্তমানে সফলভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করছে এবং এটিই পৃথিবীর সাথে চাং’ই-৪ এর যোগাযোগ বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয়, চাং’ই-৪ মিশনের অংশ হিসেবে ৪৫ কেজি ওজনের ছোট দুটি মাইক্রোস্যাটেলাইটও পাঠিয়েছিল চীন। তবে এর মাঝে লংজিয়াং-১ সফলভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। লংজিয়াং-২ গন্তব্যে পৌঁছেছে এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
নাসা অ্যাডমিনস্ট্রেটর জিম ব্রিন্ডেস্টাইন চীনাদের এই অর্জনকে ‘দারুণ এক অর্জন’ বলে আখ্যা দিয়ে টুইট করেছেন। এদিকে অস্ট্রেলিয়ান স্পেস এজেন্সি শুধু অভিবাদন জানানো ছাড়া এ ব্যাপারে আর তেমন কিছু বলতে রাজি হয়নি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটিজিক পলিসি ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ম্যালকম ডেভিস চীনকে অভিবাদন জানিয়ে বলেছেন,
এটি শুধু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই নয়, এর সাথে ভূ-রাজনীতি এবং মহাকাশ-রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। চীন মূলত নিজেদেরকে বিশাল এক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই এসব করছে। চাং’ই-৪ এর এই সফল অবতরণ আমেরিকানদেরকে ভালোরকম ধাক্কা দেবে। সম্ভাবনা আছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘোষণাও দিবে চীন। আমেরিকানদের পর দ্বিতীয় জাতি হিসেবে চাঁদের মাটিতে কোনো চৈনিক মানবের পায়ের ছাপ পড়বে— এই ধারণা তাদের ঠিক পছন্দ হওয়ার কথা না।
আসলে আমেরিকার উদ্বেগের পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। বিবিসির তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে মহাকাশের বুকে চীনই সবচেয়ে বেশি রকেট পাঠিয়েছে। সংখ্যাটা কত হতে পারে বলে মনে হয় আপনার? না, ১০-২০টি নয়, সংখ্যাটি হচ্ছে ৩৮! এর আগে এক বছরে সর্বোচ্চ সংখ্যক রকেট পাঠানো হয়েছিল মাত্র ২২টি। রেকর্ডটি ২০১৬ সালের। এতগুলো রকেট পাঠানো এবং অন্যান্য কর্মকান্ড সবকিছু মিলে মহাকাশ কর্মসূচীর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ সেবছর চীনের খরচ ছিল ৫ বিলিয়নের ডলারেরও কম! চীন যে কত দ্রুত উন্নতি করছে, এখান থেকে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পরে তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজেদের মহাকাশযানে করে মহাকাশে নভোচারীও পাঠিয়েছে চীন। নভোচারীদেরকে নিয়ে প্রথম চৈনিক মহাকাশযানটি ঘুরে এসেছিল ২০০৩ সালে। এরপর এ পর্যন্ত ১১ জন চীনা মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন।
এদিকে ২০১১ সালে টিয়াংগং-১ দিয়ে মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করা শুরু করেছে চীন। টিয়াংগং শব্দের অর্থ ‘স্বর্গের প্রাসাদ’। ২০১২ সালে একজন চীনা মহিলা নভোচারীও সেই স্বর্গের প্রাসাদ থেকে ঘুরে এসেছেন। এরপর ২০১৬ সালে দুজন নভোচারী সেখানে একমাস কাটিয়ে এসেছেন।
২০১৬ সালে টিয়াংগং-১ এর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে সেটি ভূপাতিত হয় এবং আশ্রয় নেয় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে। কিন্তু টিয়াংগং-২ এখনো সফলভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তবে, এই স্টেশনগুলো ছিল খুবই ছোট। সেজন্য চীন ঘোষণা দিয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যেই তারা মহাকাশে একটি পূর্ণাঙ্গ মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করতে চায়। ম্যালকম ডেভিসের মতে,
মহাকাশ নিয়ে চীনের এত আগ্রহের পেছনে একটি বড় কারণ হলো চিন মহাকাশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। চীন তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। তারা চাঁদকে দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ানের সাথে আর গ্রহাণুদেরকে পূর্ব চীন সাগরের সাথে তুলনা করেছে। মহাকাশে যা ঘটছে, তার সাথে তারা ভূ-রাজনীতিকে ভালোভাবে তুলনা করেই সামনে এগোচ্ছে এবং আমাদের অবশ্যই এদিকে মনযোগ দেয়া দরকার।