সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ
ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ—সংক্ষেপে টিওবি নামে পরিচিত। আদতে ভ্রমণ ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের ফেসবুক গ্রুপ। প্রায় ৯ লাখ মানুষের এই গ্রুপে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়েই কথা হয়। তবে দলটির সদস্যরা বলেন, ‘টিওবি একটি মতাদর্শ’। তাঁদের কাছে ভ্রমণ মানেই নিজেকে চেনা, প্রকৃতি-মানুষকে জানা। এ বছরই এক দশক পূর্ণ করল প্ল্যাটফর্মটি। এক দশকের যাত্রায় দলটির তরুণ সদস্যরা নানা উদ্যোগ নিয়ে হাজির হয়েছেন মাঠে-ঘাটে-পাহাড়ে-জঙ্গলে। চলুন, পরিচিত হওয়া যাক এই তরুণ ঘুরিয়েদের সঙ্গে।
ফেসবুক গ্রুপটিকে ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশের সদস্যরা বলেন খোলা উঠান। তো সে উন্মুক্ত উঠানে কী আলোচনা হয়, তা-ই দেখতে ঢুঁ মারা। দৃষ্টি কাড়ল নাহিদুল আলমের পোস্টটি। মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় কীভাবে তিনি ভারতের দার্জিলিং ঘুরে এসেছেন, সে গল্পই লিখেছেন। তাঁর মতো ‘রাজার হালে’ কেউ দার্জিলিং ঘুরে আসতে চাইলে কীভাবে কী করতে হবে, সুন্দর বর্ণনায় উঠে এসেছে সে কথাই। নাহিদুলের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা গ্রুপে এখন ব্যাপক আলোচিত। প্রায় ৬২ হাজার মানুষ তাঁর লেখাটিতে ‘লাইক’ করেছেন, ‘শেয়ার’ করেছেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ।
মুনতাহা ইবনাত নামে একজনের লেখাটিও প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে। পাঁচজন অনূঢ়া মিলে কীভাবে সিলেটের কয়েকটি পর্যটন স্থানে পা রেখেছেন, সে অভিজ্ঞতাই তিনি লিখেছেন। তারপর সজল জাহিদের লেখাটি। আলাদাভাবে নজর কাড়ল সেটা। তিনি ভারতের গোয়া ভ্রমণে গিয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে সেখানকার পার্থক্যগুলো তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোর হোটেল থেকে রিকশাওয়ালারা যে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন, তারই তুলনামূলক চিত্রই উঠে এসে লেখায়। ‘পাইছেন টু্যরিস্ট, কামাইয়া লন!’—শিরোনামে তাঁর ধারাবাহিক লেখার এটি ছিল পঞ্চম পর্ব।
ফেসবুকের খোলা উঠান থেকে আমরা আসি পেছনের মানুষদের সামনে।২৯ মে সন্ধ্যায় ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশের সদস্যদের সঙ্গে আলাপের শুরুতেই খটকা বাধাল ‘ঝাড়ুদার’ শব্দটি। একজন হয়তো বলছেন, ‘আমরা ঝাড়ুদারেরা মিলে সব কাজ করি’, তাঁর কথা ধরে আরেকজন বলছেন, ‘ও কিন্তু ঝাড়ুদার হিসেবে বেশি সক্রিয়’! একদল ভ্রমণপ্রিয় মানুষের পরিচিতির সঙ্গে ‘ঝাড়ুদার’ শব্দটির সম্পর্ক যে কোথায়, খটকা লাগার কারণটা এ-ই। তবে একটু পরই উন্মোচন হলো ঝাড়ুদার রহস্য।
ঝাড়ু হাতে আমরা যে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মানুষটাকে চিনি, সে শব্দের ভিন্ন অর্থ ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশের (টিওবি) সদস্যদের কাছে। তাঁরা ঝাড়ুদার বলেন টিওবি ফেসবুক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণকারীদের। কারণটা সাদামাটা, প্রতিদিন প্রায় এক হাজার পোস্ট অনুমোদনের জন্য জমা হয় ফেসবুক গ্রুপে। বিনা পারিশ্রমিকের এই অ্যাডমিন ও মডারেটরদের কাজ হলো পোস্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়া, মান বিবেচনা করা, কোনো পোস্টে অহেতুক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আছে কি না বিচার করা, তারপরই পোস্টটি সবার জন্য অনুমোদন করা। শুধু কি তাই—প্রতিটি পোস্টে অহেতুক মন্তব্যটিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা অর্থাৎ মুছে ফেলাও তাঁদের কাজ। আরও আছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উটকো ঝামেলা বাধানো মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
ব্যবস্থা’ শব্দটায় আপত্তি তুললেন মুনীম চৌধুরী, ‘ঠিক ব্যবস্থা নয়। আমরা বুঝিয়ে বলি। গ্রুপের বিধিবিধান মেনে চলতে বলি। তারপরও নিয়ম না মানলে গ্রুপ থেকে সরিয়ে দিই।’ মুনীম এই গ্রুপে ‘শিশু অ্যাডমিন’ হিসেবে পরিচিত। তঁার এমন পরিচয়ের কারণ, সবার ছোট। ছোট বলতে যতটা ছোট মনে হয়, তিনি ততটা ছোট নন। স্নাতক পড়ুয়া। তাঁর মতো ১৬ জন মিলে এই গ্রুপ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করেন। যাঁদের মধ্যে আছে প্রকৌশলী-ব্যাংকার-ব্যবসায়ী থেকে সদ্য স্নাতক।
আলাপ যখন এটুকু এগিয়েছে, তখন মুখ খুললেন ফয়সল কাইয়ুম। তিনি বললেন, ‘শুধু ফেসবুক গ্রুপটিই আমাদের পরিচয় নয়। এটি একটি অংশমাত্র। আমরা মনে করি টিওবি একটি মতাদর্শ। আমাদের নিজেদের অনেক কার্যক্রম আছে, আছে অন্তরালের অনেক মানুষও।’
ফয়সল কাইয়ুমের অন্তরালের মানুষদের কথা ধীরে ধীরে যেমন পরিষ্কার হলো, তেমন পরিষ্কার হলো তাঁদের মতাদর্শ কী সেটাও। জানা গেল, ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশের এই পেছনের মানুষেরা ব্যাকপ্যাকিং মানসিকতার ভ্রমণকে উৎসাহিত করেন। তাঁরা শুধু গন্তব্য স্পর্শ করার তথাকথিত যাত্রাকে ভ্রমণ মনে করেন না, বরং তাঁরা চান ভ্রমণ যেন পরিণত হয় একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতায়। নিজের বা নিজেদের প্রচেষ্টায় স্বাধীনভাবে এই ঘোরাঘুরি যেন হয়ে ওঠে জীবনযাপনেরই অংশ। আরও একটি ব্যাপার হলো তাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন—খ্যাপাটে পর্যটক, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ হিসেবে। এমন খ্যাপাটে মানুষদের নিয়েই একসময় টিওবির যাত্রা শুরু হয়েছিল।
সমমনাদের সম্মিলন
যাত্রা শুরুর কথা উঠতেই মুখ খুললেন রাহাত খান। ২০০৮ সালের কথা। তখন তিনি সদ্য স্নাতক। অ্যাডভেঞ্চারে ব্যাপক আগ্রহ। ব্যাকপ্যাক পিঠে হুটহাট বেরিয়ে পড়েন, ঘুরে বেড়ান দেশের নানা প্রান্তে। ঘুরে বেড়ানো মানুষটা হঠাৎ দুর্ঘটনায় আহত হলেন। একদম ঘরবন্দী। সেই ঘরবন্দী রাহাতের হাতেই জন্ম নিল—ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপক রাহাত খান বলছিলেন, ‘এখন যেমন চাইলেই মানুষ বেরিয়ে পড়তে পারেন কিংবা পড়েন। তখনো তরুণদের মধ্য ব্যাকপ্যাক ভ্রমণের এমন চল অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। হাতে গোনা কয়েকটি গ্রুপ ঘুরে বেড়াত। তাই তথ্যের সীমাবদ্ধতা ছিল। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম কোনো এলাকায় ঘুরতে যাব তেমন তথ্য পাওয়া যেত না। তাই সমমনা মানুষদের এক কাতারে আনার চেষ্টা থেকে আমাদের যাত্রা।’
শুধু ব্যাকপ্যাক ভ্রমণই নয়, তখন ফেসবুকও অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ফেসবুকে গ্রুপ খোলার ধারণাও নতুন। সেই সময় তারা সমমনা মানুষ মিলে ভ্রমণবিষয়ক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার গ্রুপের যাত্রা শুরু করল। দিনভর নতুন নতুন ভ্রমণের জায়গা নিয়ে আলোচনা। স্বল্প খরচে কীভাবে ঘুরে আসা যায় সেসব নিয়েই কথা হতো। নিজেরাই তখন আয়োজন করতেন বিভিন্ন ইভেন্ট। দিনে দিনে বাড়তে থাকল ভ্রমণপ্রিয় মানুষের সংখ্যা, বাড়তে থাকল গ্রুপ সদস্য। ৫ হাজার, ১০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ করে এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ লাখে। বিশাল এই পরিবার হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অসংখ্য গল্প। নিজেরা যখন কোথাও আড্ডায় শামিল হন, সেসব নিয়েই প্রতিনিয়ত আলাপ তাঁদের।