ব্যক্তি ও শিল্পপতি নুরুল ইসলামকে যেমন দেখেছি

গত ১৪ জুলাই যুগান্তরের শিরোনাম ছিল ‘সফল স্বপ্নসারথির চিরবিদায়’। ঢাকা মহানগরসহ দেশের প্রধান নগরীগুলো থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকারই প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম ছিল যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা জনাব নুরুল ইসলামের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে। এর আগের দিন ১৩ জুলাই অপরাহ্নে মৃত্যুর পরপরই খবরটি সব অনলাইন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে। দীর্ঘ ৪৫ বছরের বহু ঘটনার সাথী, বহু আড্ডার সাথী, বহু কল্পনার সাথী জনাব নুরুল ইসলামের ইন্তেকালের সংবাদ পেয়ে আমি নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।

 

ওই সময়টিতে আমি ডিস্ক প্রোলাপস বা পেছনে কোমরের ব্যথায় ভুগছিলাম। তাই হাসপাতালে ছুটে যেতে পারিনি, পরদিন জানাজায়ও যেতে পারিনি। শারীরিক অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হওয়ার পর আমার স্ত্রী ফোরকান ইবরাহিমকে সঙ্গে নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছি। আমি বিয়ে করার তিন-চার বছর পর উভয় পরিবারের পরিচয় হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৭৫ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের কোনো একটি দিন থেকে। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল হালকাভাবে। পরিচয়টি আরেকটু গাঢ় হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

২০২০ সালের জুন মাসে যখন জনাব নুরুল ইসলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হন, তখনই তার স্ত্রী সম্মানিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের কাছ থেকে ঘটনাটি তাৎক্ষণিক জানতে পারি। ইতোমধ্যেই জনাব নুরুল ইসলাম রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং চিকিৎসা চলছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওখানেই চিকিৎসা হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে ও বেইজিং থেকে চিকিৎসকরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন এবং সব চিকিৎসক তথা এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন জনাব নুরুল ইসলামকে সারিয়ে তুলতে। মহান আল্লাহর ইচ্ছা, তিনি ইন্তেকাল করবেন, তাই তিনি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। অনেক শিল্পপতি ইন্তেকাল করেছেন করোনার আগে ও করোনাকালে। কিন্তু জনাব নুরুল ইসলামের মতো আলোচিত খুব কমই হয়েছেন। এর অনেক কারণ; আমি আলাপচারিতার মতো করে এ সংক্রান্ত কিছু কথা এখানে লিখছি।

২০১৯ সালের প্রথমদিকে আমার রাজনৈতিক ব্যস্ততা খুব কম ছিল। তখন জনাব নুরুল ইসলামের সঙ্গে সফরে যেতাম। ২০১৮-১৯ সময়টাতে তিনি প্রতি শুক্রবার অতি ভোরে রওনা দিয়ে চলে যেতেন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বেজুড়া গ্রামে, নির্মীয়মাণ বা উদীয়মান যমুনা শিল্পনগরীতে। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার যে মহাসড়ক, তার পাশেই সেই শিল্পনগরী অবস্থিত। একটি আয়তক্ষেত্রের মতো এলাকাজুড়ে গড়ে উঠছিল শিল্পনগরী। একপাশে প্রায় দেড় কিলোমিটার, অপর পাশে প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা। সেখানে অনেক ফ্যাক্টরির ভৌত কাঠামো তখন গড়ে উঠছিল। একটি ছিল গাড়ির টায়ার বানানোর কারখানা এবং বাংলাদেশে সব টায়ারের চাহিদার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ এ কারখানা থেকে মেটানোর কথা। জনাব নুরুল ইসলাম প্রতি শুক্রবার সরেজমিন গিয়ে ওখানে উদীয়মান বা গড়ে উঠছে এমনসব শিল্প প্রকল্প তদারক করে আসতেন।

আমিও এক শুক্রবারে গেলাম। তার সঙ্গে, তার গাড়িতে করে। শিল্প এলাকাটিতে বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিভিন্ন প্রকৃতির আওয়াজ। কোথাও মাটি ভরাট হচ্ছে, কোথাও ফ্যাক্টরির ফ্লোর ঢালাই হচ্ছে, কোথাও মেশিন বসানো হচ্ছে, কোথাও রাস্তা সমান করা হচ্ছে কার্পেটিং করার জন্য। প্রবেশ গেটের কাছেই তিনি এবং আমি নেমে গেলাম। তখন সকাল সাড়ে ৯টা। আড়াই ঘণ্টা হেঁটে একটা রাউন্ড শেষ করা হল। কোনো সময় বালুর মধ্য দিয়ে, কোনো সময় সমান হাঁটা রাস্তা দিয়ে। আমি নীরব দর্শক; কিন্তু সেখানে কিছু প্রবীণ লোক তার কর্মযজ্ঞে জড়িত ছিলেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের যোদ্ধা। তারা ১৯৭১ সালের লেফটেন্যান্ট ইবরাহিমকে ৪৮ বছর পর সশরীরে দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলেন।

যদিও ৩ নম্বর সেক্টরের নন; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তো বটে, তাই মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম কর্তৃক তাদের এলাকায় শিল্পনগরী স্থাপনের প্রক্রিয়ায় তারা অনেক আগ্রহ নিয়েই জড়িত ছিলেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বপূর্ণ এলাকার মধ্যে অন্যতম ছিল তৎকালীন সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা। ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর ছিল প্রথম তিন মাস মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া ইউনিয়নের তেলিয়াপাড়া গ্রামে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বিপরীতে ভারতীয় গ্রাম সিমনায়।

শিল্পনগরীর কথায় ফিরে আসি। বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছিল। প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে আলাদা আলাদাভাবে উন্মুক্ত ময়দানে প্লাস্টিক চেয়ারে বসে জনাব নুরুল ইসলাম তার নির্দেশনাগুলো দিলেন। স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার ও সুপারভাইজাররা সেগুলো শুনে নিচ্ছেন। অতঃপর তিনি সবাইকে বললেন, আজকে আমার সঙ্গে মেহমান আছে, সেজন্য এখানে আপনাদের সঙ্গে খাব না; মেহমানকে নিয়ে দূরে যাব। আজকের জন্য বিদায়। আমরা প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে একটি রিসোর্টে গেলাম, সেখানে জুমার নামাজ পড়লাম এবং দুপুরে রেস্টুরেন্টে খেলাম। সন্ধ্যা ৭টা বা সাড়ে ৭টার মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে ফিরে এলাম।

বিভিন্ন সময়ে জনাব নুরুল ইসলামের সঙ্গে আমি তার টেক্সটাইল মিল, ইলেকট্রিক এক্সেসরিস উৎপাদনের কারখানা, পেগাসাস সু ফ্যাক্টরি দেখতে গেছি। তার আগ্রহ ছিল তার পরিশ্রমের ফসল দেখানোয়; আমার আগ্রহ ছিল শেখা ও জানার। তিনি ছিলেন ভীষণ উদ্যমী ও পরিশ্রমী। তার জীবনের শেষ পাঁচ বছর বাদ দিলাম। তার আগের বছরগুলোতে সপ্তাহে ছয় দিনের প্রতিদিন অফিসে দুপুরবেলা খাওয়ার পর তিনি ঢাকা মহানগরী ছেড়ে গাজীপুর জেলায় বিভিন্ন স্থানে যেখানে তার কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান অবস্থিত, সেখানে চলে যেতেন। দুপুরবেলা আড়াইটা থেকে ৩টার দিকে ঢাকা মহানগরীর অফিস ছাড়তেন এবং রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কোনো এক সময় গুলশানে তার বাসায় ফিরতেন। যদি সন্ধ্যারাতে বাসায় কোনো মেহমানের দাওয়াত থাকত, তাহলে কিছুটা সময় আগে আসতেন।

একজন শিল্পপতি যিনি তার জীবদ্দশায় ৪১টি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন এবং চালু রেখেছেন, তিনি এত পরিশ্রম না করলেও পারতেন। কেন পরিশ্রম করতেন? উত্তর খুব সোজা। তার ভাষায়, আমি মালিক, আমার অন্তরে আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য, আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জন্য, আমার প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য যে মমত্ববোধ, যে উৎকণ্ঠা কাজ করবে, সেটা বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের মনে ওই পরিমাণে করবে না এবং এরূপ না করাটাই স্বাভাবিক। আরেকটি কারণ, আমি কারখানায় উপস্থিত থাকলে যে কোনো সমস্যা আমার কাছে তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয় এবং আমি সেটির হয় সমাধান দিই অথবা সমাধানের উপায় বাতলে দিই অথবা সমাধানের নিমিত্তে কর্মপন্থা দিই। আমাদের শিল্পজগতে যদি তথাকথিত আমলাতান্ত্রিক লালফিতার দৌরাত্ম্য ঢোকে, তাহলে মারাত্মক ক্ষতি।

মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে রাস্তা চলে গেছে বঙ্গভবনের পেছনে ইত্তেফাক বা টিকাটুলি মোড়ের দিকে। শাপলা চত্বর থেকে ২০০ মিটার গেলেই বামদিকে লাল রঙের একটি বিল্ডিং আছে, যেটাকে সবাই ওয়াপদা বিল্ডিং বলে চেনে। সেটার নিচতলাতেই আনুমানিক ৪০ ফিট বাই ৪০ ফিট কামরায় তার অফিস ছিল আশির দশকের শুরুর দিকে। একই রুমে সেলস কাউন্টার ও শোরুম। অন্যতম সহকর্মী ছিলেন জনাব জাহিদ। সেখান থেকে বৃহত্তর অফিসে যান ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের বিপরীতে আরেকটি বিল্ডিংয়ের চারতলা কিংবা পাঁচতলায়।

সেখানেও ছিলেন কয়েক বছর। সেখান থেকে অফিস বদলিয়ে আসেন সেনাকল্যাণ ভবনে। সেনাকল্যাণ ভবনের একটি পুরো ফ্লোরের প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ নিয়ে বিস্তৃত ছিল যমুনা গ্রুপের সদর দফতর। জানালা খুললেই ঢাকা মহানগর দেখা যেত। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশেই, প্রায় বারো কিংবা পনেরো বছর লেগেছে যমুনা ফিউচার পার্ক নামক বিশাল দালানটি গড়ে তুলতে। এত দীর্ঘ সময় লাগার পেছনে কোনোমতেই যমুনা গ্রুপ বা জনাব নুরুল ইসলাম দায়ী নন। রাজউক অথবা প্রতিবেশী বসুন্ধরা গ্রুপের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণেই বিলম্ব। যমুনা ফিউচার পার্ক চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যমুনা গ্রুপের সদর দফতরও সেখানে চলে আসে।

নুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে অনেক সময় তার অফিসেও গল্প-গুজব হয়েছে। আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর, রাজনীতিতে আসার বহু বছর আগে থেকেই অনেক সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতাকে দেখেছি বা শুনেছি জনাব নুরুল ইসলামের অফিসে গিয়ে গল্প-গুজব করতে।

নুরুল ইসলাম প্রজ্ঞাবান, বাস্তবসম্মত কর্মে বিশ্বাসী একজন শিল্পপতিই শুধু ছিলেন না; তিনি অত্যন্ত রাজনীতি সমঝদার ব্যক্তিও ছিলেন। যেহেতু বড় বড় দলগুলোর অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় ওঠাবসা ছিল, সেহেতু রাজনৈতিক কথাবার্তা ও রাজনৈতিক চিন্তা আদান-প্রদান হওয়াটাও স্বাভাবিক ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি এককভাবে নিবেদিত ছিলেন না, সব দলের ভালো কর্মের সঙ্গে তিনি ছিলেন। তবে তার গভীর সম্পর্ক ছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও তার দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে। জনাব নুরুল ইসলামের সম্মানিত স্ত্রী জাতীয় পার্টির নমিনেশনেই সংসদ সদস্য হন এবং ছয়-সাত বছর আগে মহাজোট সরকারের আমলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনাব নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে একান্ত আগ্রহী ছিলেন। দেশ সেবার অংশ হিসেবেই তিনি যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

যমুনা ফিউচার পার্ক সকাল-বিকাল হাঁটার বা প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য কোনো পার্ক নয়। এখানে রয়েছে আধুনিক সব সুবিধাসম্পন্ন বিশাল দালান বা শপিংমল, যেখানে বিশ্বমানের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিশ্বমানের অনেক স্টোর আছে, অতি আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ আছে, ব্যায়ামাগার আছে, বিশাল পার্কিং স্পেস আছে। যমুনা টেলিভিশন চালু হওয়ার আগে সম্প্রচার করার সরকারি অনুমতি অনেক বছর আটকে ছিল। বাংলাদেশে একমাত্র টেরিস্ট্রিয়াল টিভি হচ্ছে বিটিভি। যমুনা টিভিও এ লাইসেন্স নিয়েছিল এবং চালু হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তারপর সরকারের হস্তক্ষেপে বহু বছর আটকে থাকে। হাইকোর্টের রায় অনুকূলে পাওয়ার পরও আটকে ছিল। ওইরকম আটকে থাকা অবস্থায় একদিন যমুনা টিভি দেখতে গিয়েছিলাম। নুরুল ইসলাম প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখিয়েছিলেন। মেহমান ছিলাম দু’জন- একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ, অন্যজন আমি। বৃত্তান্ত শুনে দুঃখই লেগেছিল। যা হোক, শুকরিয়া এতটুকু যে, শেষতক যমুনা টিভি চালু হয়েছে এবং এখন অন্যতম নেতৃস্থানীয় ও দর্শকের আস্থাভাজন একটি টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে পরিচিত। অনেকদিন যমুনা টিভিতে টকশোতে গিয়েছি; আবার অনেকদিন ধরে যাওয়াও হচ্ছে না।

যমুনা গ্রুপ মানে কিন্তু শুধু শিল্প নয়, যমুনা গ্রুপের মালিকানাধীন ব্যতিক্রমী সেবা হচ্ছে যুগান্তর নামক বিখ্যাত পত্রিকা। ২০০১ সালে জনাব নুরুল ইসলামের আগ্রহে যুগান্তর বের হয়। জনাব নুরুল ইসলাম দাওয়াত দিয়েছিলেন যুগান্তরের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে। আমি আমার সেই সময়কালের সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য তার দাওয়াত গ্রহণ করতে পারিনি; কিন্তু যুগান্তরের বয়স যত বছর, যত দিন, আমি যুগান্তর পরিবারের সদস্য তত বছর, তত দিন। আমার নিজের লেখা ৬টি মৌলিক বই আছে এবং ৭টি সংকলন বা সম্পাদিত বই আছে। মৌলিক বইগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বইটি হচ্ছে : ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’; ২০০১ সালে প্রকাশিত। বইটি প্রকাশের আগে ৩৬ দিন এর কিছু কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। তখন যুগান্তরের সম্পাদক ছিলেন জনাব গোলাম সারওয়ার। যুগান্তর এখন অন্যতম একটি সুপ্রতিষ্ঠিত জনগণের আকাক্সক্ষা লালনকারী পত্রিকা।

জনাব নুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, সাবেক আমলা ও ব্যাংকার তার সম্পর্কে লিখেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আলোচনাসভা হয়েছে, স্মৃতিচারণ হয়েছে, দোয়া মাহফিল হয়েছে। আপাতত আমি সর্বশেষ ব্যক্তি লিখছি। জনাব নুরুল ইসলামের অনেক গুণাবলির কথা উঠে এসেছে। দু’-একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা আমিও লিখেছি। ইতোমধ্যে প্রকাশিত অনেক লেখায় উঠে এসেছে, তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন না। ২০২০ সালের বাংলাদেশে এটি কল্পনা করা কঠিন যে, একজন শিল্পপতি ঋণখেলাপি নন; অথবা ওই শিল্পপতি বিদেশে টাকা জমা করেননি। এক্ষেত্রে জনাব নুরুল ইসলাম ব্যতিক্রম, যিনি বিদেশে টাকা জমা করেননি এবং যিনি ঋণখেলাপি নন। অনেকদিন গল্পের সময় তিনি আফসোস করেছেন- যারা ঋণখেলাপি বা যারা টাকা পাচারকারী, তারা নতুন করে ঋণ পায় দ্রুত। আর যারা সততার সঙ্গে বাণিজ্য ও শিল্প করে, তারা ঋণ পায় অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে। তিনি বা তার স্ত্রী কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না। তিনি শ্রমিকবান্ধব ছিলেন, দরিদ্রবান্ধব ছিলেন।

অত্যন্ত পরিবারবান্ধব ব্যক্তি ছিলেন জনাব নুরুল ইসলাম। কোনো ক্লাবে গিয়ে সময় কাটাতেন না এবং না যাওয়ার জন্য কোনো আফসোসও করতেন না। ৩৫-৪০ বছর আগের বনানী-৪ নম্বর রোডের বাসায় অথবা গুলশান-২ নম্বর রোডের বাসায় দেখেছি, তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল মোটামুটি সহজ-সরল। আসবাবপত্র দামি ও অভিজাত সংস্করণ; কিন্তু মানুষগুলোর চালচলন সহজ-সরল। জনাব সালমা ইসলাম উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল জনাব নুরুল ইসলামের সঙ্গে। স্বামীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং উৎসাহে বিয়ের পর তিনি ধাপে ধাপে লেখাপড়া শেষ করেছেন। মাস্টার্স করার পর এলএলবি করেছেন। ঢাকা বার কাউন্সিল কমিটির নির্বাচিত সদস্য হয়েছিলেন।

সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। এতকিছুর মধ্য দিয়েও সালমা ইসলাম তিন কন্যা ও এক পুত্রকে বড় করেছেন, অনেক দেবর-ননদ এবং শাশুড়িকে নিয়ে সংসার করেছেন। রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন, প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। একমাত্র পুত্র শামীম ইসলাম ক্যাডেট কলেজে পড়েছেন এইচএসসি পর্যন্ত; এরপর চলে যান ইংল্যান্ডে এবং ছয় বছর পর লেখাপড়া শেষ করে দেশে আসেন। শামীম ইসলামের পিতামাতা তাকে গড়ে তুলেছেন পিতার অবর্তমানে এ শিল্প সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নেয়ার জন্য। জনাব নুরুল ইসলাম ও সালমা ইসলামের তিন কন্যাই উচ্চশিক্ষিত, তিনজনের স্বামী উচ্চশিক্ষিত এবং তিনজনই পিতার শিল্প সাম্রাজ্যে ব্যবস্থাপনার হাতেখড়ি নিয়েছেন। যে বছর আমি ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে বছরমেয়াদি লেখাপড়ার জন্য গিয়েছিলাম, সে বছর তার কনিষ্ঠতম কন্যার জন্ম।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে মানুষ অগ্রসর হয়। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়। যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর বয়স ৪৫ বছর পার হল। যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর এক লাখের কাছাকাছি শ্রমিক ও তাদের পরিবার, যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর পণ্যের কোটি কোটি ভোক্তা, যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর নীরব সহায়তা পায় এমন লাখ লাখ গরিব পরিবার, যুগান্তরের অগণিত পাঠক, যমুনা টিভির অগণিত দর্শক- সবাই শোকাহত হয়েছেন জনাব নুরুল ইসলামের মৃত্যুতে। আমি, আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলেমেয়েরাও শোকাহত হয়েছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ডিএমও’র বাসায়, ভাটিয়ারিতে বিএমএ’র কমান্ড্যান্টের বাসায়, যশোরে জিওসি’র বাসায় আমরা মিলিত হয়েছি, গল্প করেছি; সেগুলো স্মৃতি। হঠাৎ করে যখন ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আমার চাকরি চলে গেল, কর্তৃপক্ষ যখন আমাকে সরকারি গাড়িও দিল না, সরকারি বাড়িও দিল না; তখন জনাব নুরুল ইসলাম সহমর্মী ছিলেন। আমি যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর সব প্রতিষ্ঠানের, সবার মঙ্গল কামনা করি।

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম : বীর প্রতীক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

mgsmibrahim@gmail.com

 

সূত্রঃ যুগান্তর