সারা অঙ্গে ব্যথা, মলম লাগাব কোথা?

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বললে সবাই সেই প্রচলিত কথাটি শুনিয়ে দেয়। বলে, ‘ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ সংস্কারবিমুখ মানুষের চিন্তার স্থবিরতাকে ইঙ্গিত করে এমন একটি বাস্তবতার কথা বলা হয়েছে। এ চিন্তাকে সার্বিকীকরণ করা যাবে না। অনেকেই ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ চলার পথ নির্মাণ করেন।

আমাদের দেশের আধুনিক কালপরিসরকে বিশ্লেষণ করে এখানে রাজনীতি অঞ্চলের ক্ষমতাবান মানুষকেই কেবল মনে হয় জ্ঞান ও চিন্তনের পথ ধরে নয়; তারা রাজনীতিতে সবল থাকতে চান পেশিশক্তি আর কূটকৌশলের মধ্য দিয়ে। কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে তারা ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম লেখানোর ব্যাপারে আগ্রহী নন; বরং নিজেদের সময়কালটিকে উপভোগ্য করে রাখতে চান।

এদিকে আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকানো যেতে পারে। ভুঁইফোড় আর ঐতিহ্যবাহী সব দলও নীতি-আদর্শে যেন একাকার হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ে গর্ব করবে অথবা ইতিহাস স্বর্ণ সিংহাসনে বসাবে, তেমন পরিচর্যা নেই কোনো দলের।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে একমাত্র আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব ছিল একটি আদর্শিক ও জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত দল হিসেবে ইতিহাসে নিজের উজ্জ্বল অবস্থান তৈরি করা; কিন্তু ক্ষমতাপ্রিয়তার কাছে বারবার আদর্শ হেরে গেছে। আওয়ামী লীগ প্রধান ও সরকার প্রধানের দায়িত্বে থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশকে এগিয়ে নিতে দৃঢ়চিত্ত-এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দল ও সরকারকে কলুষমুক্ত করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। যেভাবে অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতি বাড়ছে এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাচ্ছে, তা দেখে অনেকটা সাত শতকের মাৎস্যন্যায়ের কথাই মনে হবে।

অন্যায়-দুর্নীতি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, একে সামাল দেয়া খুব সহজ বলে মনে হয় না। সুবিধাভোগীরা অনেকটা রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো। তাড়াতে চাইলে উল্টো হামলে পড়বে। সামনে আসা সাহেদ, পাপুল, সাবরিনা শুধু নয়; দুর্নীতি, জালিয়াতি আর প্রতারণার জাল এখন সর্বত্র ছড়ানো। স্বাস্থ্য খাতের পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি তো এখন সর্বজনবিদিত।

এ সূত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় নতুন ডিজির জন্য আমাদের রয়েছে আতঙ্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলতে চেয়েছেন, তিনি একজন সৎ মানুষ। আমার শঙ্কা, যে উনুনের ওপর তিনি বসেছেন; সেখানে টিকে থেকে দুর্নীতির অসংখ্য ছিদ্র বন্ধ করে সুবাতাস বইয়ে দিতে হলে সৎ আর সজ্জন হলেই চলবে না। হতে হবে প্রশাসন অভিজ্ঞ, দৃঢ়চেতা ও সাহসী ব্যক্তিত্ব।

ধরে নিচ্ছি, বর্তমান ডিজির সেসব গুণ রয়েছে। কিন্তু এসব গুণের সমন্বয় থাকলেই চলবে না। তার পেছনে থাকতে হবে শুভ রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন। কেনাকাটায় স্বচ্ছতা আনতে হলে তদবিরবাজদের ত্রিসীমানার বাইরে রাখতে হবে। একই ধরনের মানসিকতা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে থাকতে হবে পাশে। পেছনে থাকতে হবে সরকারি সদিচ্ছা।

স্বচ্ছতা আনার জন্য দলীয়করণ নীতির সমূল উৎপাটন করতে হবে সরকার ও দলের নীতিনির্ধারকদের। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করার মানসিকতা না থাকলে এবং অনন্যোপায় হলে ডিজি মহোদয়ের মুহূর্তে পদত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে ডিজি মহোদয়কে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে।

দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা নানাদিকে বিস্তৃত। আমার সামনে ২৩ জুলাইয়ের যুগান্তর। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় দুটো রিপোর্টে দুর্নীতির বৈচিত্র্য লক্ষ করা যাবে। একটির শিরোনাম ‘তেল কোম্পানি এসএওসিএলের হিসাব জালিয়াতি-দু’শ কোটি টাকা লোপাট’। এ কোম্পানির ৫০ শতাংশ মালিকানা সরকারের। সরকারের হওয়ার অর্থ দুর্নীতিবাজদের পৈতৃক সম্পত্তি হয়ে যাওয়া।

তাই দুর্নীতিবাজদের একটি সিন্ডিকেট অবলীলায় দু’শ কোটি টাকার বেশি জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে ফেলেছে। যুগান্তরের আরেক খবরের শিরোনাম ‘হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ-টাস্কফোর্সের জরিপে সাগর চুরির চিত্র’। এখন তো যে কোনো নির্মাণ বা সংস্কারে চুরি গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে নতুনত্ব হচ্ছে, আগে পুকুর চুরি হতো; এখন এর আধুনিকায়ন হয়েছে। এখন সাগর-মহাসাগর চুরি লিখতে হচ্ছে কাগজগুলোকে।

বর্তমান সময়ে দুর্নীতি হচ্ছে না কোথায়, তা বের করা রীতিমতো গবেষণার বিষয়।

করোনা সংকটের শুরুতে ত্রাণের চাল চুরি নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। অবশ্য ত্রাণ চুরির সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সংযুক্ত থেকে দুর্নীতি করাটা খুব প্রাচীন বিষয়। তবে এবার এ চাল দুর্নীতি বিবেকের প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে। করোনা মহামারীর পদধ্বনিতে সাধারণ মানুষ যখন মহাসংকটে, তখন অসহায় মানুষের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়া কতটা অমানবিক হতে পারে!

এসব বিবেকহীন অন্যায়কারীর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতাই বেরিয়ে আসে কেবল। এরা বেশিরভাগ স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি। বেশিরভাগ সরকারি দলসংশ্লিষ্ট। নির্বাচনের আগে যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল সৎ ও দায়িত্বশীল জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া। এসব ঘটনার পর এসব নেতাকে কি প্রশ্নের আওতায় আনা হয়েছে?

পত্রিকার পাতায় আজকাল বিচিত্র অন্যায়ের চিত্র দৃষ্টি ফেললেই দেখা যায়। এ ধারাবাহিকতায় ২৩ জুলাই যুগান্তরের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় খবর বেরোলো ‘ভোলায় জেলে বেশি দেখিয়ে ৫ গুণ চাল বরাদ্দ’। আপৎকালীন জেলেদের সরকারি প্রণোদনার চাল বরাদ্দ চলছিল বেশ ক’বছর ধরে।

এবার সেখানেও দাঁত বসান জনপ্রতিনিধিরা। যেখানে জেলের সংখ্যা ২০ হাজার সেখানে ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭ জনের জন্য চাল বরাদ্দ নিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই এ বরাদ্দ দিয়েছেন। এ জালিয়াতি সরকারি অনুসন্ধানে ধরা পড়েনি। বেরিয়ে আসে পত্রিকার সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে।

কিছু কিছু দুর্নীতি আছে যা অনুসন্ধান করে বের করতে হয় না। বছরের পর বছর চোখের সামনে দুর্নীতি হচ্ছে। মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। রাজধানীর (চট্টগ্রামসহ অন্য শহরেরও অভিন্ন চিত্র) বিভিন্ন সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের খোঁড়াখুঁড়িতে রাজধানীর বেহাল অবস্থা। রাজধানীর কোনো কোনো অংশের মানুষ কয়েক বছর অবর্ণনীয় কষ্ট মেনে নিয়েছে এ আশ্বাসে যে, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে; আর কষ্ট থাকবে না।

কোনো কোনো জায়গায় স্বস্তি এলেও অনেক জায়গায় ‘হযবরল’ অবস্থা। ড্রেনের পেছনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হলেও এ মাসের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর সড়কে নদী দৃশ্যমান হয়েছে। ২৩ জুলাইয়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ওয়াসার এমডির শাসন, দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ’। ভেতরে রয়েছে দুর্নীতির নানারকম চিত্র।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতি নেই কোথায়! কোথাও আর্থিক দুর্নীতি, কোথাও চারিত্রিক দুর্নীতি; আবার কোথাও দলবাজির দুর্নীতি। আসলে প্রশাসন ও রাজনীতির উচ্চস্তরে সততা না থাকলে অধস্তন সব স্তরই দুর্নীতি করার সব ধরনের লাইসেন্স পেয়ে যায়। এ জন্য এ দেশে দুর্নীতি সর্বব্যাপী। আর্থিক কেলেঙ্কারি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর (মন্ত্রণালয়!) যেমন ডুবিয়েছে স্বাস্থ্য খাত, অন্যান্য সরকারি মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন কি এর বাইরে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে মেধার চেয়েও যখন রাজনৈতিক হিসাব বড় হয়ে যায় তখন এ ক্ষেত্র থেকেও ভালো কিছু আসা করা যায় না।

আবার বুদ্ধির প্রয়োগও থাকে। কোন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতে শিক্ষক বানাব; আর কাকে বানাব না, তেমন অঙ্কও অনেক ক্ষেত্রে অঙ্কুরেই করা হয়ে যায়। তাই অ-শিক্ষকরা ফলাফলকে গড়াপেটা করেন। এভাবে প্রকৃত মেধাবীর জীবন ক্ষতবিক্ষত করে কম মেধাবীকে টেনে আনা হয়। ফলে বহিরাঙ্গের আইন ঠিক রেখে দলবাজি ও ক্ষমতাবাজি জিতে যায়। এমন ভয়ংকর দুর্নীতিও তো শিক্ষা-সমাজে দৃশ্যমান।

যদিও নতুন নয়, তবুও দুদিন আগের একটি ঘটনা মনটিকে খুব কষ্ট দিল। এক গৃহকর্মী জানাল তার কন্যার বিয়ের জন্য ‘ভালো’ পাত্র ঠিক হয়েছে। এ জন্য ৩ লাখ টাকা যৌতুক দিতে হবে। ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির একটি চাকরি লাভের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এ জন্য তদবিরকারীদের ৬ লাখ টাকা দিতে হবে। পাত্রপক্ষ এর অর্ধেকটিই মাত্র যৌতুক চেয়েছে।

গত সপ্তাহে সদ্য অবসরে যাওয়া আমার স্নেহভাজন বন্ধু দুঃখের সঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় তার বাড়ি। ডেভেলপাররা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তিনি এখন চারটে ফ্ল্যাটের মালিক। একটিতে থাকেন আর তিনটি ভাড়া দেন। করোনা সংকটে দুটি খালি হয়ে গেছে। এখন কষ্টেই চলতে হচ্ছে। আমার জানামতে, সততার সঙ্গে জীবন নির্বাহ করে আসছেন তিনি।

সেদিন বাড়ি থেকে টেলিফোন পেলেন। সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শকরা এসেছেন। কথা বলবেন। ভদ্রলোক ফোনে পরিদর্শকের সঙ্গে কথা বললেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তারা এসেছেন। জানালেন, ‘আপনার বাড়ি সবদিক থেকে পরিচ্ছন্ন। তবে দোতলায় ঝুলে থাকা তারে একটি খাবারের প্যাকেট পেয়েছেন। সেখানে জমা বৃষ্টির পানিতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন। এখন রিপোর্ট করতে হবে। আপনার পাঁচ হাজার টাকা ফাইন হবে।’

বন্ধুটি জানালেন, তিনি সতর্কভাবে নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন। যদি সত্যিই এমন ভুল হয়ে থাকে তাহলে তিনি আরও সতর্ক থাকবেন। এবারের মতো ফাইন না করার জন্য অনুরোধ করলেন। ওপাশের পরিদর্শক বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আমি তো একা নই। আমার সঙ্গে আরও লোক আছে; তাদের মানানো যাবে না।

আমার সত্যনিষ্ঠ ভদ্রলোক ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে বললেন, তাহলে আর কী করা যাবে; আপনারা আইন প্রয়োগ করুন। সন্ধ্যায় বাসায় এলে কেয়ারটেকার হাসি দিয়ে জানাল, স্যার! ওরা আসলে পয়সার জন্য এসেছিল। আমি এ ইন্সপেক্টরদের চিনি। ওরা আমার কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে সব ফয়সালা করে দিয়ে চলে গেছে। বন্ধুটি কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি লার্ভা দেখেছ? ওর উত্তর, দেখতে চেয়েছিলাম। বলল, পানিটুকু ফেলে দিয়েছে।

পাঠক! বলুন, কী দোষ দেব এ পুঁচকে দুর্নীতিবাজদের। এরা মাথার ওপর যেদিকে তাকিয়েছে, সেখানেই বড় দুর্নীতিবাজদের দেখেছে; আর নিজেরা অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং শক্তি পেয়েছে। পচনধরা রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের সর্বত্রই তো ব্যথা। উপশমের জন্য কোথায় মলম লাগাব?

আমরা নই- বিধায়করাই সম্ভবত এর উত্তর জানেন।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর