ব্যাংকিং খাতে কোনো কিছুই আর ‘অবিশ্বাস্য’ নয়

এমডিকে গুলি করার কথা চিন্তাও করা যায় না উক্তিটি আমার না, এ দেশের একজন বিখ্যাত ব্যাংকারের, যিনি মাঝেমধ্যেই ব্যাংক খাতে অনিয়ম নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলেন। সেই সূত্রে আমরা তাকে চিনি, পছন্দ করি।

একটি দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। প্রসঙ্গ, দেশের এক বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠীর এমডি এবং তার ভাই একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করা এবং এমডি-ডিএমডিকে আটকে রেখে হুমকি দেয়া।

ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এরপর আসে আরও কিছু ‘চাঞ্চল্যকর’ তথ্য। আক্রান্ত এমডি-ডিএমডি ঘটনা ঘটার কয়েকদিন পরে মামলা করেন এবং তারপর পুলিশ দুই ভাইকে খুঁজতে শুরু করে। সর্বশেষ জানা যায়, এই করোনার সময়ে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সময়েও এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই ভাই ব্যাংকক গেছেন।

এর জন্য যা যা প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়েছিল সেটি এ রকম : থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসার অনুমতি চেয়ে ২৩ মে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। সেই দিনই অনুমোদন দেয় থাই সরকার।

তারপর ঢাকায় থাই দূতাবাসে চিঠি দিয়ে দু’জনের মেডিকেল ভিসা দেয়ার অনুরোধ করা হয়। পরদিন ২৪ মে ভিসা ইস্যু হয়ে যায় এবং তার পরের দিন তারা ব্যাংককের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

একটি প্রতিষ্ঠিত নিউজ পোর্টাল পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিল কীভাবে এয়ারপোর্ট দিয়ে তারা চলে গেল, তারা বাধা দিল না কেন? পুলিশ জানিয়েছিল, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং মামলার ব্যাপারে কিছুই জানত না তারা। অথচ মামলা হয়েছিল ১৯ মে আর এ দুই ভাই দেশ ছেড়েছেন ২৫ মে।

ঋণ না পেয়ে একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মালিক যদি একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করা এবং আটকে রেখে হুমকি দেয়া যদি চিন্তাও করা না যায়, তাহলে এরপরে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী হবে?

আমাদের কি আরও বড় ধাক্কা খাওয়ার কথা? যদি সেটা খাই, তাহলে প্রশ্ন আমরা কি এই দেশে বাস করছিলাম না? আমরা কি দেখছিলাম না বছরের পর বছর কী হচ্ছে ব্যাংকিং খাত নিয়ে?

আমরা একটা ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলাম, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ২০১৩ সালে। প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে এত টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া যায় অবলীলায়, সেটা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। সেটা কী পন্থায় হয় একটা ধারণাও পেয়েছিলাম সেটার।

এরপর অনেকেই আবার অবাক হলেও আমি আর হইনি। বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ আরও অনেক ব্যাংকে একের পর এক হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি আমাদের সামনে এলো।

একটি নবপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংক, সাবেক ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিনিয়ত সবার চোখের সামনে টাকা সরিয়ে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছিল। কারোই কিছু হল না। শুধু কপাল পুড়ল মাঝারি পর্যায়ের কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার, যারা চাকরি টেকাতে ঋণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুমোদনে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য ছিলেন।

এর মধ্যে একজন ব্যক্তি, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কথা তো বহুবার এসেছে। সংসদে তাকে নিয়ে কথা হয়েছে, সরকারি দলেরও কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক এমপি, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস তাকে গ্রেফতার না করা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন।

এ বছরের জানুয়ারিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্টভাবে বলেন, সেই আলোচিত ব্যক্তি একাই বেসিক ব্যাংক শেষ করে দিয়েছেন।

ওই সাক্ষাৎকালে জনাব মুহিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এর পরে এসেছে। পত্রিকাটি ঠিক তারপরই তাকে জিজ্ঞেস করে, আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারলেন না কেন? মুহিতের জবাব হুবহু এটা- আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।

পরে পত্রিকার চাপাচাপিতে এটুকু যুক্ত করেন বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার সংযোগ ছিল এবং এগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা ফিরে আসব শেষে।

আগেই বলেছি, ব্যাংকের টাকা লুটপাটের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনা কিন্তু সেখানে থেমেও থাকেনি, বরং একটার পর একটা সুবিধা এই টাকা লুটপাটকারীদের দেয়া হয়েছে।

পরিবার থেকে ব্যাংক পরিচালক হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি, তাদের মেয়াদ বাড়ানো, অতি তুচ্ছ পরিমাণ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিয়ে আরও ঋণ নিয়ে সেটাও লুট করার পথ করে দেয়া হয়েছে। শাস্তি দূরেই থাকুক, এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র যখন এ লুটপাটকারীদের আরও প্রণোদনা দিতে থাকে ক্রমাগত, তখন পরিস্থিতি আমাদের না বোঝার কোনো কারণ থাকে না।

শিকদার গ্রুপের ঘটনা আমাদের সামনে এলো, কারণ এখানে একজন এমডি ঋণ দেবেন না বলে বেঁকে বসেছিলেন। সেজন্যই এত ঘটনা ঘটল এবং প্রকাশ্য হল সবকিছু। ভুক্তভোগী এমডি ওই শিল্পগ্রুপের এমডিকে ঋণ দিতে রাজি ছিলেন না, কারণ পাঁচশ’ কোটি টাকার বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তির যে পরিমাণ মূল্য দেখানো হয়েছে, সেটি আদতে তার চেয়ে অনেক কম ছিল।

এটা কি নতুন কোনো ব্যাপার? বাংলাদেশে ইচ্ছেকৃত সব ঋণখেলাপির এটাই হল কৌশল। ঋণের অঙ্কের তুলনায় অতি তুচ্ছ পরিমাণ সম্পদের মূল্য বহুগুণ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে এ ঋণ নেয়া হয়, যাতে ঋণ ফেরত না দিলেও ব্যাংক ওটা বিক্রি করে দিলে তাদের কোনো সমস্যা না থাকে। এতদিন পর্যন্ত এটা জাস্ট প্রকাশ্য হয়নি, হয় এমডিরা আগে থেকেই ম্যানেজড হয়ে সব ঋণ পাস করে দিয়েছেন, অথবা বেঁকে বসলেও কোনো না কোনোভাবে চাপ দিয়ে তাদের ম্যানেজ করা হয়েছে।

এভাবেই কয়েক মাস আগেই আইএমএফের হিসাবে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা খেলাপি ঋণ নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করা বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। এমনকি সরকারি হিসাবেও আমাদের খেলাপি ঋণের হার পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ; পৃথিবীতেই অন্যতম সর্বোচ্চ।

কিছুদিন আগেই গাজীপুরে কর্মরত প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। একটি জাতীয় পত্রিকা এ হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে জানায়- ‘দেলোয়ার হোসেন সৎ কর্মকর্তা ছিলেন। সিটি কর্পোরেশনে নিম্নমানের উন্নয়ন কাজ করায় তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারের অন্তত শতকোটি টাকার বিল আটকে দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে কোনাবাড়ী এলাকায় এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ৩৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। জাইকা, এডিবি ও আরও একটি দাতা সংস্থার নামে পৃথক বিল তৈরি করা হয়।

অর্থাৎ মোট ৯৯ কোটি টাকার বিল করা হয়। এ ছাড়া গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সুপেয় পানির লাইন স্থাপনে শত কোটি টাকার একটি বিল তিনি অনিয়মের অভিযোগে আটকে দেন। এ কারণেই শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে’। বলা বাহুল্য, এ ঘটনাটিও আমার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়নি।

ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী বা সম্প্রতি অতি আলোচিত শিল্পগ্রুপের মালিকদের কাণ্ড কিংবা একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মাঝে মাঝেই আমাদের আলোচনায় আসে; আমরা ক্ষুব্ধ হই, বিচারের দাবি করি।

দেখি তাদের কিছু হয় না; কিন্তু তবুও দাবি করি। কেন বিচার হয় না তার জবাব দেশের দীর্ঘতম সময় কাজ করা অর্থমন্ত্রী বলেন- আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। কথা বলতে না চেয়েই বরং তিনি অনেক বেশিকিছু বলে দিয়েছেন। সেটা কি বুঝি আমরা? সেটা বুঝে কাজ করতে না পারলে ব্যাংকিং সেক্টরে ঘটবেই আরও অনেক ভয়ংকর সব ঘটনা, যদিও সেসব আমার কাছে অন্তত ‘অবিশ্বাস্য’ ঠেকবে না।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

 

সুত্রঃ যুগান্তর