৯/১১-এর শেষ কোথায়

২০ বছরে কত যুদ্ধ, কত মানুষের প্রাণহানি, কত দেশ ধ্বংসস্তূপ; তার পরও আবার ৯/১১ ঘটানোর হুমকি শোনা যাচ্ছে। তালেবানকে একটি চরম বর্বর সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে তাকে উত্খাত ও ধ্বংস করার জন্য ২০ বছর যুদ্ধ করল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সঙ্গী মিত্রপক্ষ পশ্চিম ইউরোপের ন্যাটো শক্তি। তার ফল কী হলো, ২০২১ সালে এসে ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। যে তালেবান বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য ২০ বছরের যুদ্ধ, সেই তালেবানকে আবার আগের মতো আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসার সুযোগ করে দিয়ে আমেরিকা যেভাবে সব ছেড়ে চলে গেল, তার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

যে পাকিস্তান তালেবান উৎখাতে আমেরিকার সহযোগী ছিল; সেই পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সাঈদ ইউসুফ বললেন, তালেবান সরকারকে বিশ্বসম্প্রদায় যদি স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে আবার ৯/১১-এর মতো ঘটনা ঘটবে। গত সপ্তাহে খবরে দেখলাম, সব সন্ত্রাসের নাটের গুরু পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান তালেবানকে শলাপরামর্শ দিতে কাবুলে গেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একটু ঘুরিয়ে প্রায় একই কথা বলেছেন। পাকিস্তানের মিলিটারি তালেবানের বিজয়কে নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে, সেটা আর নতুন কথা নয়।

পাকিস্তান মনে করছে, তালেবান তাদের প্রক্সি হিসেবে কাজ করবে। ভণ্ডামি ও প্রতারণায় পাকিস্তানের জুড়ি নেই। ইমরান খান বলেছেন, দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত হয়ে এবারই আফগানবাসী সত্যিকারার্থে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু ২০ বছর যদি আফগানবাসী দাসত্বের কবলে থেকে থাকে, তাহলে সেই দাসত্বের জন্য আমেরিকার একান্ত সঙ্গী ছিল পাকিস্তান। একটু আগের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইসলামিস্ট সন্ত্রাসের জন্য পাকিস্তানই মূল কালপ্রিট এবং ৯/১১-এর জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদা তৈরির প্রধান কারিগর আইএসআই। আশির দশকে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে হটাতে সৌদি আরব ও আমেরিকার হিসাবহীন অর্থ ও অস্ত্র পেয়েছে আইএসআই, যার বড় অংশ তারা ব্যবহার করেছে ভারতের বিরুদ্ধ জিহাদি তৈরিতে এবং বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস বিস্তারের কাজে। ভূ-রাজনীতির কৌশলের একটা অংশ বোধ হয় এই, বড় শত্রুকে শেষ করার জন্য আপাতত ছোট শত্রুকে সঙ্গে নেওয়া যায়। বড় শত্রু শেষ হলে তারপর ছোট শত্রুকে গলা টিপে মারা হবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই ফর্মুলা সব সময় সফল হয়নি। তখনকার ছোট শত্রু চীনকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা বড় শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু এখন চীনের চ্যালেঞ্জের মুখে অনেক জায়গা থেকেই আমেরিকা পিছু হটছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ আফগানিস্তান।

আসল কথায় আসি। ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক পৃথিবীর সব প্রান্ত, পশ্চিমে মরক্কো থেকে পূর্বে ফিলিপাইনের মিন্দানাও পর্যন্ত যত উগ্রপন্থী ওয়াহাবিবাদী ইসলামিস্ট সংগঠন আছে, সবাইকে করাচিতে আসার আহ্বান জানান এবং সবার জন্য অর্থসহ অফিস ও মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন, সঙ্গে সশস্ত্র জিহাদি প্রশিক্ষণ (‘হুসেন হাক্কানী-পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’, পৃ-১৯১)। সে সময়ে ফিলিস্তিনের ওয়াহাবিবাদী ইসলামিক পণ্ডিত আবদুল্লাহ আযম মুসলিম যুবকদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিশাল এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন করাচিতে, যার নাম মকতব-আল-খিদমত  (MAK)|  সৌদি আরব থেকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান লাদেন এসে মকতব-আল-খিদমতে যোগ দেন এবং শিগগিরই আইএসআইয়ের প্রধান সেনাপতি হয়ে ওঠেন। আফগান থেকে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লাদেন সোমালিয়ায় চলে যান এবং আল-শাবাব নামের জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেন। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের সরাসরি সহায়তায় তালেবান ক্ষমতায় এলে লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় নেন। আমেরিকান ও ইহুদিদের হত্যা করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব, ১৯৯৮ সালে এই মর্মে ফতোয়া দেন লাদেন (প্রাগুক্ত, পৃ-৩০৭)। সে বছরই ৭ আগস্ট লাদেনের নির্দেশে আল-শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠী কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় এবং তাতে নিহত হন স্থানীয়সহ কয়েক শ আমেরিকান। পাল্টা হিসেবে আমেরিকা পারস্য উপসাগরের যুদ্ধজাহাজ থেকে আফগানিস্তানে লাদেনের অবস্থানকে পিন পয়েন্ট টার্গেট ঠিক করে মিসাইল আক্রমণ চালায়। কিন্তু মিসাইল আঘাত করার আগমুহূর্তে আইএসআই টের পেয়ে জরুরি বেতার বার্তায় খবর দিলে সেখান থেকে লাদেন সরে যান এবং বেঁচে যান (প্রাগুক্ত, পৃ-২৯৯)। ১৯৯৯ সালে ভারতের সঙ্গে কারগিল যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের দ্বারস্থ হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। নওয়াজ শরিফের মুখের ওপর ক্লিনটন বলেন, ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা ও তালেবানের মতো জঙ্গি সংগঠনকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সব ধরনের সমর্থন ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে আফগানিস্তান ও ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত আছে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ (প্রাগুক্ত, পৃ-২৫৩)। সুতরাং পাকিস্তান যদি ওসামা বিন লাদেনকে সব রকম সমর্থন না দিত, তাহলে ১৯৯৮ সালেই আমেরিকার মিসাইল আক্রমণে লাদেন নিহত হতেন এবং হয়তো ৯/১১ ঘটত না। সেই সময় আমেরিকা যদি ভূ-রাজনীতির ডাবল গেমে না গিয়ে সরাসরি পাকিস্তানকে জবাবদিহির মধ্যে আনত, তাহলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, এত দিন পর আবার ৯/১১-এর হুমকি সৃষ্টি হতো না। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবানসহ বিশ্বের সব প্রান্তের জিহাদি সংগঠন যে এক ও অভিন্ন তার ছোট দুটি উদাহরণ দিই। দারুল উলুম হাক্কানী নামে পেশোয়ারে এক বিশাল মাদরাসা আছে, যাকে জিহাদি বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। ২০০১ সালের ৯ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রপন্থী ওয়াহাবিবাদী ইসলামিস্টদের একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। তাতে চীনের উইঘুর, মধ্য এশিয়া, চেচনিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ ৩০টি দেশের জিহাদি সংগঠনের নেতারা যোগ দেন। সে সময় তালেবান সরকারের প্রায় অর্ধডজন মন্ত্রী ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান আসলাম বেগ ও সাবেক আইএসআই প্রধান জেনারেল হামিদ গুল। সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়, মুসলিমবিশ্বের সেরা সেনাপতি ওসামা বিন লাদেনকে রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব (জহিদ হুসেন, ফ্রন্টলাইন পাকিস্তান, পৃ-৮৩-৮৪)।

অনেকের মনে থাকার কথা, ২০১৫ সালে ইরাক-সিরিয়ার আইএস যোদ্ধারা পশ্চিমা বিশ্বের বন্দিদের মাথা কালো কাপড়ে ঢেকে তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করত এবং সেই বর্বর দৃশ্যের ভিডিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিত। জিহাদিরা বন্দিদের মাথার ওপর তলোয়ার ধরে বলত, ‘তোরা ওসামা বিন লাদনকে যে সাগরে ফেলেছিস, তোদেরও সেই সাগরে নিক্ষেপ করা হবে।’ আইএস যদি আলাদাই হবে, তাহলে তারা ওসামা বিন লাদেনের কথা এভাবে বলছে কেন। আয়মান আল জাওয়াহিরির লেখা— ‘Knights under the prophet’s (sm) Banner’ গ্রন্থে আল-কায়েদার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বর্ণনা আছে। সেটা পড়লে বোঝা যায়, মূল মতাদর্শের জায়গায় তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তাদের শত্রুও এক ও অভিন্ন। সুতরাং বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সশস্ত্র সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন নাম ও নেতৃত্ব তাদের সবার সম্মিলিত স্ট্র্যাটেজি। তাই পাকিস্তানের উল্লাস অচিরেই ফুরিয়ে যাবে। আয়মান আল জাওয়াহিরির বইয়ের বর্ণনায় সব মুসলিমপ্রধান দেশ নিয়ে একটি বৃহত্তর ইসলামিক খেলাফত তৈরির যে কথা আছে তার প্রথম টার্গেট হবে পাকিস্তান। কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও পাকিস্তানের ভেতর থেকে জনগণ ও সামরিক বাহিনীর বড় একটা অংশ তাতে সমর্থন দেবে। আফগানিস্তানের তালেবান পাকিস্তানের সহায়তা নিয়েই সুসংহত হবে। কিন্তু আইএস ও তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আগের মতো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নতুন উদ্যমে সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা শুরু করবে। শুধু ভারত বিরোধিতায় অন্ধ হয়ে গত ৭৪ বছর পাকিস্তান যেভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ওয়াহাবিতন্ত্রকে লালন-পালন করে আসছে, তারাই একদিন ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবের মতো পাকিস্তানকে গিলে খাবে। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিতে তালেবান ওয়াদা করে, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে আফগানিস্তানে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না এবং চূড়ান্ত প্রত্যাহারের জন্য নির্ধারিত সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত আমেরিকান বাহিনীর ওপর আক্রমণ হবে না। কিন্তু গত ২৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে আইএস খোরাশানের আক্রমণে ১৩ জন আমেরিকান সেনাসহ প্রায় ১৮০ জন নিহত হয়েছে। নিরাপত্তা সম্পর্কিত মেকানিজম সম্পর্কে যাঁরা অবহিত তাঁরা সবাই বুঝবেন, সেখানে চারদিকে তালেবানের নিরাপত্তাবেষ্টনী রয়েছে। সেখানে আইএস খোরাশান তালেবান বাহিনীর সম্মতি ছাড়া এত বড় আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে চলে যাবে, তা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আবির্ভাবের পর ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৭ বছরে তালেবানের এমন কোনো রেকর্ড বা উদাহরণ নেই, যার ওপর ভিত্তি করে তালেবানের আপাত ভালো কথায় আস্থা রাখা যায়। সুতরাং ভবিষ্যৎ বিশ্বশান্তি এবং গত ২০ বছরে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে বিশ্বসম্প্রদায় যেন তালেবানকে বিশ্বাস না করে। একই সঙ্গে ৯/১১-এর শেষ দেখতে চাইলে বিশ্বসম্প্রদায়কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ