১৯৯০ সালেই বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণ হতে পারত বাংলাদেশের!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

অনেক চরাইউৎরাই পার হয়ে অবশেষে ১৯৯৭ সালে স্বপ্নপূরণ। ২৩ বছর আগে এপ্রিল মাসের ৯ তারিখ স্কটল্যান্ডের সঙ্গে সেমিফাইনালে জয়ের মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয়ে গেছিল টাইগারদের বিশ্বকাপ খেলার টিকিট। চারদিন পর (১৩ এপ্রিল) মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জেতার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে এক দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের।

যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম আইসিসি ট্রফির মধ্য দিয়ে। তারপর ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে না পাওয়ার বেদনায় নীল হওয়া। আর সবশেষে ১৯৯৭ সালে গিয়ে সাফল্যের ‘সোনার হরিণের’ নাগাল পাওয়া। একবার, দুই বার নয়- ছয় বারের চেষ্টায় ধরা দেয় অভূতপূর্ব সাফল্য। তার আগের ইতিহাস শুধুই আক্ষেপ আর অনুশোচনার।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ১৯৯৭ সালের আগে কি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল? আগের ৫ আসরে কখনও কি বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার আশা জাগিয়েছিল? অনেকেই বলেন এবং বেশিরভাগ ক্রিকেট অনুরাগীর ধারণা, ১৯৯৪ সালেও বাংলাদেশের যথেষ্ঠ সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল।

তা যে ছিল না, তা নয়। সেবার ফাইনাল না খেলে তৃতীয় হলেও বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ ছিল। নতুন নিয়ম করে আইসিসি ট্রফি থেকে তিনটি দলকে বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন, রানার্স আপ এমনকি তৃতীয় হলেও ১৯৯৬ সালে উপমহাদেশে হওয়া বিশ্বকাপ খেলা যেত। কিন্তু তা হয়নি।

মহিন্দর অমরনাথের একগুয়েমি, একাদশ সাজানোয় অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা আর ভাইটাল ম্যাচে নির্ভরযোগ্য পারফরমারদের সময় মত জ্বলে উঠতে না পারা এবং সর্বোপরি বোলিং দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেবার স্বপ্নপূরণের বদলে হতাশাই হয় সঙ্গী।

তবে জেনে হয়তো অবাক হবেন! তারও আগে, ১৯৯০ সালেও কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার ভাল সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল। কোন মনগড়া সংলাপ কিংবা মিথ্যে নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার অন্যতম সফল যোদ্ধা মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর কথা।

দেশের ক্রিকেটের এ উজ্জ্বল তারা কিন্তু তাই মনে করেন। শুধু মনেই করেন না, সাবেক অধিনায়ক ও আজকের প্রধান নির্বাচক নান্নুর বদ্ধমূল ধারণা, শুধু দূর্ভাগ্য আর হিসেবনিকেশের একটু ভুলেই হয়নি। না হয় বাংলাদেশ হয়তো ১৯৯০ সালেই আইসিসি ট্রফি থেকে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারত।

সেটা কিভাবে? একান্ত আলাপে মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, হ্যাঁ! ১৯৯০ সালের দলটি সত্যিই বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই করার মত। নান্নুর মতে, ‘১৯৯০ আর ১৯৯৭ সালের দল দুটি ছিল প্রায় সমান সমান। দুই দলেই বেশ কিছু মেধাবী ও কার্যকর পারফরমার ছিল। তবে আমার মনে হয় বাংলাদেশের ১৯৯০ সালের দলটি ছিল অন্যতম সেরা দল।’

‘এক ঝাঁক মেধাবী ও ইনফর্ম পারফরমারে সাজানো। সে দলে আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, নুরুল আবেদিন নোবেল, এনামুল হক মণি, ফারুক আহমেদ, জি এম নওশের প্রিন্স, গোলাম ফারুক সুরু, আজহার হোসেন শান্টু আর জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দুলুর মত কার্যকর পারফরমার ছিলেন। টিম কম্বিনেশন বা দলের গঠনশৈলিও ছিল বেশ সাজানো গোছানো। মুদাসসার নজরের মাসখানেকের প্রশিক্ষণে আমরা তৈরিও ছিলাম বেশ। কিন্তু একটু হিসেব গড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় সেমিফাইনালের বেড়া টপকানো সম্ভব হয়নি। না হয় ১৯৯০’তেই হতে পারত স্বপ্নপূরণ।’

কিভাবে সে সুযোগ হাত ছাড়া হয়েছিল? সে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নান্নুর ব্যাখ্যা, ‘আমরা প্রথম গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচের সব কয়টায় (কেনিয়া, বারমুডা আর ফিজি) জিতে আসি দ্বিতীয় রাউন্ডে। সেই পর্বেও আমরা তিন ম্যাচের দুটিতে (কানাডা আর ডেনমার্ক) জিতি।’

‘কিন্তু একটি ম্যাচে হিসেব কষে খেলতে না পারায় রান রেটে পিছিয়ে পড়ে রানার্সআপ হই। আর তাতেই খেলা পড়ে যায় ঐ সময়ে আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর এক নম্বর শক্তি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। হিসেবটা দাঁড়ায় এমন, আমরা একটি ম্যাচে আর ১৫টা রান বেশি করলেই হয়তো স্বাগতিক নেদারল্যান্ডসকে টপকে গ্রুপে এক নম্বর হতাম। তাহলেই সেমিতে জিম্বাবুয়েকে এড়ানো যেত।’

মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর কথার যথার্থতা মেলে নেট রানরেটে। পরিসংখ্যান পরিষ্কার সাক্ষী দিচ্ছে, সেবার প্রথম পর্বে সব ম্যাচ জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে পুল বি’তে বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের পয়েন্ট সমান (৮ পয়েন্ট) হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের (৩.৬২) চেয়ে নেদারল্যান্ডস (৩.৬৮) নেট রানরেটে একটু এগিয়ে থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়।

উল্লেখ্য, ঐ পর্বে বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডসের কাছে হারে ১৬১ রানের বিরাট ব্যবধানে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ আর ১৫টি রান বেশি করলেই নেট রানরেটটা নেদারল্যান্ডসের চেয়ে ভাল হতো। তখন আর বাংলাদেশকে জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হতে হতো না। তখন কেনিয়ার সঙ্গে খেলা পড়ত। বলে রাখা প্রয়োজন, কেনিয়াকে প্রথম পর্বের ম্যাচে ৩ উইকেটে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

বলার অপেক্ষা রাখে না, জিম্বাবুয়ে তখন আইসিসি সহযোগী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সেরা ক্রিকেট শক্তি। ব্যাটিং ও বোলিং ব্যালেন্সড। অ্যান্ডি-গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, ডেভিড হাটন আর অ্যাডো ব্রান্ডেসদের মত তুখোড় পারফরমাররা তখন জিম্বাবুয়ের মূল চালিকাশক্তি।

তবু জিম্বাবুয়ের সেই শক্তিশালী দলের বিপক্ষে সেমিতে বাংলাদেশের সামনে ছিল সুবর্ণ সুযোগ। একপর্যায়ে ৩৭ রানে ৪ উইকেট খুইয়ে বসে জিম্বাবুয়ে। আউট হওয়াদের মধ্যে জিম্বাবুয়ান ক্রিকেটের সবসময়ের অন্যতম শীর্ষ তারকা সহোদর গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার (৭) আর অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার (১) ছিলেন। কিন্তু আরেক তারকা ও বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান ডেভ হাটন ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হন।

সেই ম্যাচে ক্যাচ মিসের চরম মাশুল গোনে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ৯১ রান করা ডেভিড হটনও ইনিংসের শুরুতে গোলাম ফারুক সুরুর বলে সীমানার আশপাশে ক্যাচ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাস্ট বোলার গোলাম নওশের প্রিন্স তা ধরে রাখতে পারেননি। সেই ক্যচ হাতছাড়া হবার মাশুল গুনতে হয়।

৩৭ রানে ৪ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ের পঞ্চম উইকেট খোয়া যায় ১৩৪ রানে। ১৩৫ রানে পতন ঘটে ৬ উইকেটের। ঐ খারাপ অবস্থা থেকেও শেষ পর্যন্ত ডেভ হাটনের ৯১ আর ফাস্ট বোলার অ্যাডো ব্র্যান্ডেসের ৬৬* রানের ইনিংস দুটির ওপর ভর করে ২৩১-এ গিয়ে ঠেকে জিম্বাবুয়ে।

কিন্তু জবাবে বাংলাদেশ মাত্র ১৪৭ রানে অলআউট হয়ে যায়। শুরুতে দুই দলের অবস্থা ছিল একই। বাংলাদেশও ৪৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বসে। পরে ষষ্ঠ উইকেটে মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (৫৩) আর এনামুল হক মণি (২৮) হাল ধরেন। কিন্তু ৮৩ রানের জুটি ভাঙার পর আবার মোড়ক লাগে। ১২৮ রানে ষষ্ঠ উইকেট পতনের পর ১৪৭ এই ইনিংস শেষ হয়ে যায়।

আর তাতেই সম্ভাবনার সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। না হয় ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় যে সূর্যের দেখা মেলে, সেটা আরও ৭ বছর আগে নেদারল্যান্ডসেই উদিত হতো পারত, বাংলাদেশ খেলতে পারত ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ।