১০ দিনে তিন বুনো হাতি হত্যা, দাঁত হাড়গোড়ে পাচারকারীর চোখ

কক্সবাজারে একের পর এক মেরে ফেলা হচ্ছে বুনো হাতি। গত ১০ দিনেই তিনটি হাতি হত্যা করা হয়েছে। সরকারি বনভূমির অবৈধ দখলদাররাই হাতির অন্যতম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে হাতির দাঁত ও হাড়গোড় পাচারকারীর দলও।

কক্সবাজারে একের পর এক হাতি হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্টের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে এশিয়ান হাতি। কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ জানান, সারা দেশের ২৬৮টি মহাবিপন্ন এশিয়ান হাতির দুই-তৃতীয়াংশের বাস কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কক্সবাজারের বনাঞ্চলে এ রকম শখানেক হাতি রয়েছে।

১০ দিনের ব্যবধানে কক্সবাজারের রামু ও চকরিয়ায় একের পর এক হাতি হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে মূলত বনভূমি দখলদাররাই দায়ী বলে জানা গেছে। আবার বনভূমির পাশে যারা বসতি গেড়ে বাস করছে তারাও হাতির আরেক বিপজ্জনক শত্রু হয়ে উঠেছে। মানুষের অপ্রতিরোধ্য বনভূমি দখল করায় ক্ষিপ্ত বন্য হাতির পাল একের পর এক মানুষকে হত্যাও করে। গত দুই বছরে চকরিয়া ও লামাার ১০টি ইউনিয়নে হাতির আক্রমণে অর্ধশতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বনভূমিসংলগ্ন এলাকায় যারা বাস করে তারা হাতি তাড়ানোর জন্য নানা পদ্ধতি বেছে নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পদ্ধতি হলো আগ্নেয়াস্ত্র। গত ১০ দিনে যে তিনটি হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে এর সবই অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে। পানেরছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রধারী দখলবাজদের ভয়ে আমরা বনকর্মীরাও প্রতিনিয়ত ভয়ে তটস্থ থাকি। তবু করার কিছুই নেই।’

আবার বনভূমি দখলবাজদের নেপথ্যেও একটি গ্রুপ নীরবে হাতি হত্যার কাজে ইন্ধন জোগায় বলে অভিযোগ রয়েছে। একসময় হাতির দাঁত ও হাড়গোড় পাচারকারীচক্রও এ অঞ্চলে তৎপর ছিল। তারা নানা কৌশলে বন্য হাতি হত্যার পর দাঁত ও হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাচারের কাজে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাচারকারীচক্র বনভূমি দখলবাজদের হাতে নিয়েই নেপথ্যে এমন কাজ চালিয়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। পাচারকারীচক্রটি এখনো সক্রিয় রয়েছে বান্দরাবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। ওই এলাকা দিয়ে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় হাতি শিকার করে থাকে চক্রটি। নাইক্ষ্যংছড়ির আলীক্ষ্যং মৌজা ও ফুলতলি এলাকায় গেল বছর উপর্যুপরি দুটি হাতি হত্যার শিকার হয়েছিল। এমনকি সেই হাতি দুটির দাঁত এবং হাড়ও চক্রটি রাতের আঁধারে তুলে নিয়েছিল।

এদিকে টেকনাফ বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আশিকুর রহমান জানান, গত এপ্রিলে টেকনাফের হ্নীলা নামক স্থানে বনভূমি দখলকারী এক কৃষক বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে একটি হাতি হত্যা করেছিল। পরে রেঞ্জ কর্মকর্তা হাতিটির দুটি দাঁত সংগ্রহ করেন। একটি দাঁতের ওজন ছিল ১২ কেজি এবং অন্যটি ছিল সাত কেজি। দাঁত দুটি যখন ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের সংরক্ষণাগারে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল তখন মোবাইল ফোনে ফারুক নামের এক ব্যক্তি এক লাখ টাকায় ১২ কেজি ওজনের দাঁতটি কিনতে চেয়েছিলেন। রেঞ্জ কর্মকর্তা মনে করেন, যিনি দাঁত কিনতে চেয়েছিলেন তিনি পাচারকারীচক্রের সদস্য।

কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের শাইরার ঘোনা এলাকায় গত রবিবার হত্যা করা হয় একটি হাতি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাতিটি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই মারা গেছে। সেই সঙ্গে হাতির পায়ে একটি গুলিও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে রামুর পানেরছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান জানান, পরিকল্পিতভাবে হাতিটি হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে গত সোমবার রামুর জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের জঙ্গলে আরো একটি বন্য হাতি হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের সহকারী ভেটেরিনারি সার্জন মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তিনি আহত হাতিটির চিকিৎসা করেও বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাতিটিকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়ে হত্যাকারীরা। এর আগে গত ৮ নভেম্বর চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের কালাপাড়া জঙ্গলে মাত্র তিন বছর বয়সের একটি হাতির বাচ্চাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীর দল সরকারি বনভূমি দখলকারী লোকজন।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের টেকনাফ বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ আশিকুর রহমান বলেন, শুধু সীমান্তবর্তী টেকনাফের বনাঞ্চলে ছিল ৪৭টি হাতি। উখিয়ার বনাঞ্চলেও ছিল আরো বেশ কয়েকটি। এসব হাতির ‘আবাসের রাজধানী’ ছিল কুতুপালং। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলে কুতুপালংয়ের সেই হাতির আবাস গুঁড়িয়ে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির করায় হাতির পাল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ