হিজড়ারা তৃতীয় লিংগের না লিঙ্গ প্রতিবন্ধী


মো. কায়ছার আলী :

“চিতায় জ্বলে না দেহ, কবরে রাখে না কেহ। মসজিদে না জায়গা পাই, মন্দিরে মেলে না ঠাঁই। তবে কেন বানাইলা মানুষ।”এক নি:শ্বাসে এতটুকু কথা হিজরাদের যত সহজে পত্রিকায় পড়া যায়, শোনা যায়, লিখা যায়, তত সহজে এই কষ্টমাখা তাদের কথাগুলো আমরা অনুধাবন করি না বা শেয়ার করি না।এরকম মানুষের সংখ্যা দেশে জনশুমারি ও গৃহগণনা মতে ২০২২ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ১২৬১৯ জন। সমাজের চরম অবহেলিত ও অপমানিত শ্রেনীর মানুষ হিজড়া। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও পরিবারের সাথে তারা থাকতে পারে না। প্রিয় পরিবারের মানুষেরাই, আত্বীয় স্বজনেরাই পাড়া প্রতিবেশিরাই তাদের দূরে ঠেলে দেয়।অনেক মা সন্তান জন্মের দূর্বলতা প্রকাশ না করে তাদের কাছে রেখে দিলেও টিনএজড বয়সে আর সন্তানের দূর্বলতা চেপে রাখতে পারেন না।তখন বাধ্য হয়েই লোকলজ্জা বা সবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যে হিজড়াদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন।

সংসারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠাঁই না পেয়ে তারা চলে যায় হিজড়া পল্লীতে।সেখানে তাদের গুরু মা তাদের দেখভালের দায়িত্ব নেয়।জীবনের শেষপ্রান্তে অর্থাৎ মৃত্যুর পর তাদের হাত পা বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় অথবা যাচ্ছেতাই ভাবে মাটি চাপা দেওয়া হয়। তাদের কবরে প্রথমে ঢালা হয় লবণ। তারপর লাশ, তারপর দেওয়া হয় ফুল,তারপর আবার লবণ। এটার মুল কারণ হল, তাদের বিশ্বাস এভাবে তাদের কবর দিলে তাদের আগের সকল পাপ ধুয়ে মুছে যাবে এবং পরবর্তীতে তারা পূর্ণ পুরুষ বা নারী হিসাবে জন্মগ্রহন করতে পারবে।হিজড়া শাব্দিক অর্থ অক্ষম, ক্লীব, নপুংশক বা ধ্বজভঙ্গ। জন্মগত ভাবে লৈঙ্গিক ত্রুটি রয়েছে। যার কারণে তাদেরকে প্রথমেই নারী বা পূরুষ বলে চিহ্নিত করা যায় না।

স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের ভাষায় নারীও নয় ,পূরুষও নয়। এ ধরনের একটি শ্রেণীকে আমরা প্রায়ই রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে, ট্রেনে, বিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন রকম রং ঢং করে,আবার একপ্রকার হাততালি বাজিয়ে সামান্য পরিমাণ চাঁদা তুলতে দেখি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তির মতো জঘন্য কাজে জড়িত।এটা অস্বীকার করছি না।কিন্তু একবার ভেবে দেখেন তো আমরা কি তাদের মাঝে পূরোপুরি সুশিক্ষার আলো বিলিয়ে দিতে পেরেছি,সামান্যতম ভালবাসা, উদারতা স্বেচ্ছায় দেখিয়েছি বরং তাদেরকে বাধ্য করেছি বৈচিত্রময় জীবন যাপনে। আজ কিছুসংখ্যক ছাত্র /ছাত্রী যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে ঝলমল করছে সেই অদম্য মেধাবীরা কি অসামাজিক বা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে না।আপনি কাদের বিচার আগে করবেন পথহারানো হিজড়াদের না পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুদের।

শারীরিক যে কোন ত্রুটিই সমস্যার। হিজরাদের শারীরিক গঠনজনিত সমস্যা আছে। অন্যান্য শারীরিক বা অঙ্গ প্রতিবন্ধীদের মতই।সন্তান জন্মদানে (পুরুষ বা স্ত্রী প্রজনন) প্রতিবন্ধকতা থাকায় বা অঙ্গটি ভিন্ন হওয়াতেই তারা হিজড়া। তাদের শারীরিক গঠন মুলত তিন প্রকার- (১) নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী যৌনাঙ্গ থাকে না। (২)পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পূরুষ জননাঙ্গ থাকে না। (৩)উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ক্লিয়ার করে বলতে হয় । তাদের প্রসাব করার রাস্তা আছে কিন্তু যৌনপথ নেই। পুরুষ হিজড়াদের ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গ ছোট থাকে,যাতে পূর্ণতা পায় না। আবার অনেকে হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গ বলে থাকেন, এটা ভুল।মানুষ হয় পুরুষ না হয় নারী। দুই ভাগে বিভক্ত।হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গের নয়, লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। শারীরিক অন্যান্য অঙ্গ প্রায় সবগুলোই একই। হিজরা জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে সমাজসেবা অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।

হিজড়ারা সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী হিসাবে সকলের সহানুভূতি পেয়ে থাকে। পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র তাদের পাশে থাকা দরকার। সরকারের উচিত আসল হিজড়া আর কৃত্রিম হিজরা বাছাই করে তাদের আই,ডি কার্ড প্রদান করা। সাম্প্রতিক সময়ে সুনামির মত ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে ধেয়ে আসছে নতুন শব্দ “ট্রান্সজেন্ডার”। ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংখ্যাগরিষ্টের মতামত পরস্পর বিরোধী শব্দ। ট্রান্স অর্থ পরিবর্তন বা রুপান্তর। ট্রান্সজেন্ডার অর্থ হচ্ছে রুপান্তরিত লিঙ্গ। নিজের পূরুষ আইডেন্টি পরিবর্তন করে নারী আইডেন্টি গ্রহণ করা অথবা নারী আইডেন্টি পরিবর্তন করে পূরুষ আইডেন্টি গ্রহণ করার নাম ট্রান্সজেন্ডার। ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি এখন “টক অব দ্য কান্ট্রি”। ট্রান্সজেন্ডার জন্মগত বিষয় নয়,এটা বিকৃতি বা রুচিজনিত সমস্যা।

যা ক্ষুদ্র জনগোষ্টি হিজড়াদের অবমাননার শামিল। হিজড়াদের অবশ্যই মানবাধিকার আছে,সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কোন পুরুষের যদি মেয়েলি কিছু আলামত থাকে অথচ বাস্তবে সে একজন পুরুষ কিংবা কোন নারীর যদি পুরুষের কিছু আলামত থাকে অথচ সে একজন নারী। সেক্ষেত্রে সার্জারি বা ঔষধ সেবন করে, সেই সমস্যার সমাধান করা বাস্তবসম্মত। লিঙ্গ পরিবর্তন নয়, লিঙ্গ সংযোজন করা যায়।উন্নত বিশ্বের মায়েরা সন্তান গর্ভে আসার পরপরই কোন জেনেটিক সমস্যা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন। যদিও মায়ের পেটের ভ্রুণের জিন পরীক্ষা করা ব্যয়বহুল। হয়তো চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদেরকে সামনে দিনগুলোতে এমন সুসংবাদ দিবে যেকোন সন্তান আর হিজড়া, প্রতিবন্ধী, ডাউন সিনড্রোম, অটিজম ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আর জন্ম লাভ করবে না। অফুরন্ত মহাজ্ঞানীর দেওয়া সামান্যতম জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোন কাজটি আপনার করা উচিত তা আপনিই নির্ধারণ করবেন। আপনার হাতে একটি মাত্র দিয়াশলাই এর কাঠি, তাদিয়ে সমগ্র পৃথিবী আলোময় করবেন, না জ্বলেপুড়ে ছারখার করাবেন। সে বিচারের ভার আমার নয়, আপনার।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪,  kaisardinajpur@yahoo.com