স্মরণকালের মহাবিপর্যয় রাজশাহী-ঢাকা ট্রেনের সিডিউলে, পশ্চিমাঞ্চল জিএম বদলি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঢাকার একটি বেসরকারী কম্পানীতে চাকরি করেন রাজশাহী দুর্গাপুরের মনিরুল ইসলাম। ছুটি শেষে সোমাবার কর্মস্থলে ফিরবেন। এর জন্য রবিবার বিকেল চারটা ২০ মিনিটে রাজশাহী-ঢাকা পদ্মা ট্রেনের একটি টিকিট অনেক কষ্টে সংগ্রহে করেন তিনি। সেই অনুযায়ী ওইদিন বিকেল সাড়ে তিনটার মধ্যে দুর্গাপুর থেকে অটোরিকশাযোগে রাজশাহী রেলস্টেশনে পৌঁছান মনিরুল। কিন্তু স্টেশনে এসে ট্রেনের খবর জানতেই তাঁর চোখ যেন ছানা-বড়া। স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মচারীদের কাছে মনিরুল জানতে পারেন শনিবার রাতে ছেড়ে যাওয়া সিল্কসিটি ট্রেনটিই তখনো স্টেশনে এসে পৌঁছেনি। সিল্কসিটি আসার পরে আসবে ধূমকেতু। এরপর সেটি আবার পদ্মা হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। তবে রবিবার বিকেল চারটা ২০ মিনিটের পদ্মা কখন ছাড়বে তাঁর কোনো ঠিক নাই।

মনিরুল গতকাল মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, কর্মচারীদের নিকট থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পরে উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে কিছুক্ষণ স্টেশনেই বসে সময় কাটাতে থাকেন তিনি। পরে রিকশা নিয়ে রাজশাহী শহর ঘুরতে শুরু করেন। এরপর রাত ৯টার দিকে স্টেশনে এসে জানতে পারেন আরো এক ঘন্টা দেরি আছে। শেষে রাত ১০টার সময় ছেড়ে যায় রবিবার বিকেলের পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি।

তার আগে শত শত যাত্রী স্টেশনে বসেই অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ট্রেনের জন্য। এভাবে ঈদের পর থেকেই রাজশাহী স্টেশনে ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে ট্রেনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ঢাকায় যেতে হচ্ছে যাত্রীদের। এমনকি আগের দিন রাতের ধূমকেতু ট্রেনটি ছেড়ে যাচ্ছে পরের দিন সকালে বা ভোরে। আর রাতভর স্টেশনে বসে মশার কামড় খেয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ নিয়ে চরম ক্ষোভও ছড়িয়ে পড়েছে যাত্রীদের মাঝে। কিন্তু তার পরেও ট্রেনের সিডিউল বিপির্যয় থামানো যাচ্ছে না। এমনকি থামানোর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপও নিতে দেখা যাচ্ছে না। ঈদের আগে ও পরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে যে সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে তা স্মরণকালের ভয়াবহ বিবপর্যয় বলেও দাবি করেছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারাই।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্মকর্তাদের চরম অদক্ষতার কারণেই ঈদের আগে-পরে ট্রেনের এমন সিডিউলের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও তদারকি না থাকাসহ একই লাইনে তিনটি বিরতিহীন ট্রেন চালু করার ফলেই এই সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। এরই মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক খোন্দকার শহিদুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছে। মঙ্গলবার তাকে বদলি করা হয়। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, শহিদুল ইসলামকে অতিরিক্ত ডিজি করে বদলি করা হয়েছে। আজ তিনি সেই পদে যোগদানও করেছেন ঢাকায়।

বিষয়টি স্বীকার করে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা বলেন, ‘এমএম শাহনেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি মাত্র রেললাইন। কিন্তু এই লাইনেই তিনটি বিরতিহীন ট্রেনছাড়াও সবমিলিয়ে ৫টি আন্তঃনগর ট্রেন যোগ হয়েছে। এ কারণে লাইনে চাপ বেড়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে ট্রেন দ্রুতগতিতে চালানোও যাচ্ছে না। এ কারণেও সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে ব্যাপক। যাত্রীদেরও ভোগান্তি হচ্ছে।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘এই অঞ্চলে দ্রুত ডাবল লাইন চালু করা দরকার। তা না হলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। তবে আগামীতে সিডিউল বিপর্যয়রোধে আমরা ঈদের সময় ঢাকায় একটি করে ট্রেন স্ট্যান্ডবাই রাখবো। যাতে কোনো ট্রেন অতিরিক্ত দেরি করলেই ওই ট্রেনটি ঢাকা থেকে ছেড়ে আসতে পারে। আবার অফ ডে বলবত থাকবে। তাহলে এতোটা সঙ্কট হবে না আশা করি।’

এদিকে রাজশাহী স্টেশনের ম্যানেজার আব্দুল করিম জানান, গত রবিবার সকালের সিল্কসিটি ছেড়ে গেছে ওইদিন রাত ১১টার দিকে। আর বিকেলের পদ্মা ছেড়ে গেছে ওইদিন রাত ১০টায়। ওইদিন রাত ১১টা ২০ মিনিটের ধূমকেতু গতকাল সোমবার ভোর টার দিকে ছেড়ে গেছে। আর গতকাল সকালের সিল্কসিটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে বিকেল চারটার দিকে।
বিকেলের পদ্মা ট্রেনটি গতকাল কখন ছেড়ে যাবে তার কোনো হদিশ দিতে পারেননি রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে গতকাল সোমবার সকাল ১১টার দিকে রাজশাহী স্টেশনের অপেক্ষামাণ (ওয়েটিং রুম) কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুশ, শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের ভীড়ে যেন ধাপ ফেলানোর যায়গা নাই। সবাই অপেক্ষা করছেন যে যার মতো ট্রেনের জন্য। সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটের সিল্কসিটি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা হোসনে আরা নামের এক তরুণী অভিযোগ করে বলেন, ‘আগে ম্যাসেজ দিলে ট্রেন কতক্ষণ দেরি আছে জানা যেত। এখন তাও জানা যাচ্ছে না। ফলে স্টেশনে এসেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যারা রাজশাহী শহরের বাসিন্দা তাদের একটু ভোগান্তি কম হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা শহরের বাইরের থেকে এসেছি, তাদের ভোগান্তির শেষ নাই। ট্রেন কখন ছাড়বে জানতে না পেরে স্টেশনে এসেই ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার স্টেশনেও বসার মতো তেমন জায়গা নাই। ফলে বাধ্য হয়েই একই কক্ষে গাঁদাগাঁদি করে লোকজন অপেক্ষা করছে।’

আরেক ট্রেনযাত্রী মাশিরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন সিডিউল বিপর্যয় এর আগে কখনো দেখিনি। আবার ট্রেন কখন ছাড়বে নির্দিষ্টভাবে স্টেশন থেকে বলতেও পারছে না কেউ। ফলে স্টেশনেই কাটাতে হচ্ছে সময়। কেউ কেউ বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে জেনে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার যাদের শহরে বাড়ি তারা বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করছেন। একটু পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছি আমরা ট্রেনযাত্রীরা। কিন্তু এই ভোগান্তির কোনো সুরাহা দেখছি না। ঈদের আগে-পরে সবসময় চলছে এমন ভোগান্তি।’

অন্যদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েরই একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঈদের মধ্যে ট্রেনের বাড়তি চাপ নতুন নয়। কিন্তু এইরকম সিডিউল বিপর্যয় এর আগে কখনো ঘটেনি। এর আগেও ঈদের সময় সিডিউল বিপর্যয় হয়েছে প্রতিবার। কিন্তু সেটি ৬-৭ ঘন্টার ওপরে যায়নি। কিন্তু এবার সিডিউল বিপর্যয় ১২ ঘন্টারও বেশি হচ্ছে কখনো কখনো। যা অতিতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্মকর্তাদের চরম অদক্ষতার কারণেই ঈদের আগে-পরে ট্রেনের এমন সিডিউলের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। ঈদের সময় ট্রেন চলাচলে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও তদারকি না থাকার কারণেও ঘটেছে সিডিউল বিপর্যয়।

স/আর