সোমবার , ১ জুলাই ২০২৪ | ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বৈরাচারী শাসকদের শিরোমণি সম্রাট নিরো

Paris
জুলাই ১, ২০২৪ ১০:০৩ অপরাহ্ণ

।। মো. কায়ছার আলী ।।

অভিনয় ও কূটনীতির বিদ্যায় পারদর্শী হিসাবে আমরা ৫ম রোমান অধিপতি ‘সম্রাট নিরো”র নাম সহজেই বলতে পারি। তিনি ১৫ ডিসেম্বর ৩৭ খ্রীষ্টাব্দে অ্যান্টিয়াম ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা এগ্রিপ্পিনাও ছিলেন ভীষণ ক্ষমতা লোভী। বাবা ছিলেন নেইয়াস ডোমেতিয়াস, সম্রাট অগাস্টাস এর প্রপৌত্র। নিরোর মা তাঁর চাচা ক্লডিয়াসকে বিয়ে করেন। পরে চাচাতো বোনের সঙ্গে নিরোর বিয়েরও ব্যবস্থা করেন। উদ্দেশ্য ছিল পারিবারিকভাবে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ৫৪ খ্রীষ্টাব্দে ক্লডিয়াস মারা গেলে নিরো রোমের অধিপতি হন। গুরু মেনেকা ও অন্যান্য উপদেষ্টার পরামর্শতে নিরো চলতেন। তবে তাঁর মায়ের খবরদারি সবার উপরেই চলত। এমনকি তাঁরা মা নিরোর ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে নিরো ক্লডিয়া নামে এক রমণীর প্রেমে পড়েন এবং ১ম স্ত্রী অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর হুমকি দেন।

এ পরিস্থিতিতে নিরোর মা অক্টাভিয়ার পক্ষ নেন এবং নিরোর সৎ ভাই ব্রিটানিকাসকে সম্রাট বানানোর চক্রান্ত আটেন।ব্রিটানিকাস ছিলেন তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক। যেদিন ব্রিটানিকাসকে প্রাপ্ত বয়স্ক বলে ঘোষণা করা হবে তার একদিন আগে নিরো ব্রিটানিকাসকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করেন।এর পর থেকে নিরোর রাজকর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনে মায়ের প্রভা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে দেখা যায়। নিরোর মা তখন জনগণকে নিরোর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলে নিরো তাঁর মাকে রাজপ্রাসাদ থেকে নির্বাসিত করেন। মায়ের সাথে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি হলে এক পর্যায়ে নিরোর নির্দেশে তাঁর মাকে হত্যা করা হয়। নিরো ২য় স্ত্রী পোপ্পাইয়াকে অন্তঃসত্তা অবস্থায় লাথি মেরে হত্যা করেন। নিজের শিক্ষক ও ভাবগুরু মেনেকাকে নিজের হাতে হত্যা না করলেও গুরুকে আত্মহত্যা করতে বলে ছিলেন এবং মেনেকাও ২৩ জন উপদেষ্টা পরম নিষ্ঠার সাথে সম্রাটের নির্দেশ পালন করেছিলেন।

এরপর থেকে নিরো অমিতাচারে মেতে উঠেন। ভোগবিলাস ও লালসা চরিতার্থ করার জন্য সময় ও সম্পদ সব কিছুতেই নিরো নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং প্রবল স্বৈরশাসক হয়ে উঠেন। নিরোর নিষ্ঠুরতা,অমানবিকতা, হ্রদয়হীনতা, মানুষের প্রতি দুঃখ বেদনা যন্ত্রণার প্রতি চরম নির্বিকারত্ব। এরূপ কার্যকলাপের জন্য আজও তাঁকে স্বৈরাচারী শাসকের শিরোমণি বলা হয়। ইতিহাস ও সভ্যতার যাত্রাপথে অতীতে রোম সাম্রাজ্য ছিল সেরাদের সেরা। কেবল সম্রাট নিরোর বেলাতেই লেগেছে কালিমা। সারা দুনিয়া শাসন করেছেন রোমার শাসকেরা।

রোমান সাম্রাজ্যের প্রতাপ ও অহংকার কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।পরাক্রমশালী শাসকের রাজধানী রোমই কি না আগুনে পুড়ে অংগার হয়েছিল? ৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই রোমের অগ্নিকান্ড ছিল ভয়াবহ এক ঘটনা। ১০ দিন ধরে সে আগুন জ্বলতে থাকে।রোমের ১৪ টি অঞ্চলের মধ্যে ১০ টি অঞ্চল ভস্মীভূত হয়।এ অগ্নিকান্ডের জন্য নিরো খ্রীষ্টানদের দায়ী করেন এবং তাদের বলীর পাঁঠা বানান। ওই সময়ে রোমে খ্রীষ্টানদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তারা ছিল প্রান্তিক এবং অজনপ্রিয়। বলা হয় শহরে আগুন দেওয়ার শাস্তি হিসাবে খ্রীষ্টানদের তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন। তাদেরকে ক্রশবিদ্ধ করা হয়।

বন্য প্রাণী দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং তাদের শরীরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক রোমান অধিবাসী মনে করেন যে, নিরো স্বয়ং ডোমাস অরেয়া স্বর্ণ ভবন নির্মাণে আগুন লাগানোর আদেশ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরে এও দায়ী করা হয় যে, রোম নগরী যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন। বেহালা সে সময় আবিস্কার হয়েছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।তবে নিরো বীণা জাতীয় বিশেষ একটা বাদ্যযন্ত্র বাজানো উপভোগ করতেন। অগ্নিকান্ডের আদেশ নিয়ে নিরো সরাসরি জড়িত ছিল কি না, তা নিয়ে মতভেদ আছে।

কেননা অগ্নিকান্ডের খবর পেয়েই তিনি রোমে ফিরে আসেন এবং দ্রুত আগুন নেভানোর নির্দেশ দেন।আবার ত্রাণও পাঠান। আগুনে দাউ দাউ করে পুড়ে যাওয়ার সময় তিনি গান গাচ্ছিলেন বা শুনছিলেন। হতে পারে সম্রাট প্রাসাদের বিশালতা বাড়াতে জমির প্রয়োজনে এ কাজ করতেও পারেন,যেন প্রাসাদের সৌন্দর্য বাড়ানো যায়। আগুন নিভে গেলে সম্রাটের বাজনাও থেমে যায়।সম্রাট ঘটনাস্থলে গিয়ে আবার সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেন। নিরো রথ চালনায় খুবই দক্ষ,শিল্পী,বাদক,মঞ্চ অভিনেতা এবং বিভিন্ন খেলাধূলায় পারদর্শী ছিলেন। ৬৮ খ্রীষ্টাব্দে নিরোর অধীনে এক রাজা বিদ্রোহ করেন।তখন চারিদিকে তাঁর বিরোধীতা চরম আকার ধারণ করে।

এ মহাসুযোগে নিরোর উপদেষ্টামন্ডলী ও প্রিটোরিয়ান বাহিনী নিরোকে জনতার শত্রু বলে ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো নিরোকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। নিরো রোমের বাইরে পালিয়ে গিয়ে শহরতলীর একটি ভিলাতে আশ্রয় নেন। রক্ষীরা খবর পেয়ে তাঁকে জীবিত ধরার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। মাত্র ৩০ বছর বয়সে ৬৮ খ্রীব্দাদের ৯ই জুন ধরা পড়লে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবেন এ আশংকায় তিনি আত্মহত্যা করেন। চিৎকারে নিরোর শেষ উক্তি ছিল “কোয়ালিস আর্টিফেক্স পেরেও”।

মো. কায়ছার আলী: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সর্বশেষ - মতামত