স্বেচ্ছায় করোনার ‘হটস্পটে’ গিয়ে সেবা দিচ্ছেন ডা. মশিউর

‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য আইসোলেশন সেন্টার এবং করোনা নিবেদিত হাসপাতাল সমূহে সরকারি ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা টিমে বদলি হয়ে করোনা রোগীদের সেবা করতে ইচ্ছুক।’

এটি একজন চিকিৎসকের আবেদন। তিনি সহকারি সার্জন ডা. মশিউর রহমান। তাঁর এই আবেদনটি পুরো স্বাস্থ্য বিভাগেই নাড়া দেয়। আবেদন গৃহীত হয়। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওই চিকিৎসক এখন নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

মশিউর রহমান ৩০ এপ্রিল থেকে হাসপাতালটিতে সংযুক্তি হিসেবে কর্মরত আছেন। কখনো করোনা সন্দেহে আসা রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো আইসোলশনে থাকা অন্তত ৭০ রোগীর দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

বুধবার সকালে ১৫ মিনিটের মোবাইল ফোনের আলাচারিতায় বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ‘মরতে তো হবেই। মরবো যখন ভালো পথেই মরি। মানুষের সেবা করেই মরি। আমার নানা সুবেদার হাবিবুর রহমান (বীর উত্তম) দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ৪৬ বছর পঙ্গুতের সঙ্গে লড়েছেন। নানার কাছ থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারি নি সংগত কারণেই। তাই ভেবেছি দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে করোনার সঙ্গে যুদ্ধটা চালিয়ে যাই।’ বদলি হওয়ার আবেদনেও উল্লেখ আছে নানার বীরত্বের কথা।

ডা. মশিউর রহমানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দিতে। সাবেক সরকারি চাকুরে (বিজিবি’র ক্লার্ক) মো. বজলুর রহমান ও গৃহিনী শিরিনা আক্তার এর বড় ছেলে তিনি। সংসারে বাবা, মা ছাড়াও দুই ভাই ও এক বোন আছেন। মশিউর রহমান ৩৯তম বিসিএস ক্যাডার। এক ভাই আইন পেশায় জড়িত, আরেক ভাই পড়াশুনা করছেন। একমাত্র বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মশিউর রহমানের নানার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামে। তাঁর নানা হাবিবুর রহমান (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরসেনানী। ঢাকার নিউ মার্কেটে হাবিবুর রহমানের নামে একটি গেইট রয়েছে।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, করোনা টিমে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে বদলির জন্য গত ১৪ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক বরাবর আবেদন করেন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহকারি সার্জন ডা. মশিউর রহমান। আবদনে তিনি পরিচালক প্রশাসন এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি ঢাকা, গাজীপুর কিংবা নারায়ণগঞ্জের কোথাও বদলির জন্য আবেদনে উল্লেখ করেন।

২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বেলাল হোসেন এক প্রজ্ঞাপনে মশিউর রহমানকে নারায়ণগঞ্জে সংযুক্ত করেন। তবে তিনি মূল কর্মস্থল থেকে বেতন উত্তোলন করবেন বলে ওই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

ডা. মশিউর রহমান জানান, প্রজ্ঞাপনটি হাতে পাওয়ার পরপরই তিনি দ্রুতই নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ‘না দাবি’ ও ‘ছাড়পত্র’ সংগ্রহে দেরি হওয়া এবং যাতায়াত সংক্রান্ত কারণে যেতে দেরি হয়ে যান। তিনি ৩০ এপ্রিল নারায়নগঞ্জ এসে যোগদান করেন।

মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি যেখানে কর্মরত ছিলাম সেখানে একজনের করোনা পজেটিভ নেই। স্বউদ্যোগে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম সেটা কাজে লাগাতে পারছিলাম না। চিন্তা করি যেখানে বেশি করোনা রোগী আছে সেখানে গিয়ে সেবা দিবো। সেই চিন্তা থেকেই ঢাকার এক বন্ধুর মাধ্যমে আবেদনটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেই। করোনা রোগীদের জন্য কাজ করতে দেয়ার সুযোগের চিঠি আসার পর আমার খুবই ভালো লেগেছে।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাচ্ছি যে সারাদেশের চিকিৎসক সংকট। অনেকে ঠিকমতো সেবা পাচ্ছে না শুনে খারাপ লাগে। নতুন করে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও তাঁদের যোগদানে কিছু সময় লাগবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে খুব দ্রুতই আবেদন করি।’

তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের পুরোটাই এখন করোনা রোগীর সেবার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে ৭০ জনের মতো আইসোলেশেন আছে এ হাসপাতালে। এছাড়া করোনা সন্দেহভাজন রোগীদেরকেও এখানে সেবা দেয়া হয়। ৫১ জন চিকিৎসক পর্যায়ক্রমে এখানে সেবা দেন।

তিনি বলেন, ‘করোনা সন্দেহের সাধারন সেবায় সকাল বেলা দায়িত্ব পড়লে ৫০-৬০ জন রোগী দেখতে হয়। বিকেলে হলে ৪০ জনের মতো আর রাতে হলে ৩০ জনের মতো রোগী দেখতে হয়। এছাড়া আইশোলেন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পড়লে সবার কাছেই ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। রোগীদের স্বজনরা হাসপাতালে আসেন না। যে কারণে মোবাইল ফোনে তাঁরা খোঁজ নেন। আমি নিয়মিতই ফোন ধরে রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে স্বজনদেরকে অবহিত করি। করোনা রোগীদেরকে এভাবে সেবা দিতে পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশের জন্য মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন সেসব গল্প নানার কাছ থেকে শুনেছি। যুদ্ধাহত নানা ৪৬ বছর পঙ্গু থেকে ২০১৭ সালে মারা যান। ওনার কাছ থেকে দেশ সেবার বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ওনার অনুপ্রেরণাতেই আমার সেবার কাজে আগ্রহ বেড়েছে। একদিন তো আমাকে মরতেই হবে। মরবো যখন ভালো কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মরতে পারলেই ধন্য হবো। দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। সরকার আমাকে সম্মান দিচ্ছে। করোনা রোগীদের সেবায় ঝুঁকি থাকলেও এসবের প্রতিদান হিসেবে আমি সেবা দিয়ে যেতে চাই।’

মশিউর রহমানের পিতা মো. বজলুর রহমান বলেন, ‘করোনা রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য বদলির আবেদন করার আগে ছেলে অনুমতি নিয়েছে। আমি খুশি হয়ে সাথে সাথে বলে দিয়েছি এটা করতে। আমার ছেলে বলে মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। এখন করোনা যুদ্ধে নিজেকে সঁপে দিতে চাই। আমার খুব ভালো লাগে যে সে এখন করোনা রোগীদের সেবা দিতে পারছে।’

৩০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালের সহকারি রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ আরিফ ভূঁইয়া  বলেন, ‘আবেদন করে মশিউর রহমানের এ হাসপাতালে আসার বিষয়টি শুনে বেশ ভালো লেগেছে। উনি সেবার দেয়ার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। কাজের প্রতি ওনার বেশ আগ্রহ আছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাধারন সম্পাদক ডা. মো. শাহ আলম বলেন, ‘চিকিৎসক পেশাটাই একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। এই ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসক মশিউর রহমান যেটা করেছেন সেটা আমাদের জন্য গর্বের। চিকিৎসক পেশার মানকেও উজ্জল করবে তাঁর এমন ধরণের সেবার মন মানসিকতা।’

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ