স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত চরাঞ্চলের মানুষ

ঈষিতা পারভীন:
রাজশাহীর পবা উপজেলার ছোট্ট ভূখ- চর-খিদিরপুর ও তারানগর (খানপুর)। পদ্মার চরাঞ্চল এ ভূখন্ডের প্রায় তিন হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর  মাছ শিকার ও কৃষি কাজে। অব্যাহত নদী ভাঙন ও প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এসব মানুষের কপালে জোটে না প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাও। তাদের চিকিৎসা সেবায় সরকারিভাবে তেমন কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। তাদের মতে, চরখিদিরপুর  ও তারানগরবাসীর প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার ভরসা দুই ‘হাতুরে ডাক্তার’।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে চরখিদিরপুর ও তারানগরে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় বাসিন্দাদের সাথে। বিভিন্ন বয়সের ১২-১৫জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার মানুষের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসা সেবা না পাওয়া। চরে বসবাস করায় তাদের বিভিন্ন রোগ-বালাই লেগেই থাকে। বিশেষ করে যখন বন্যার পানিতে বাড়িঘর ডুবে যায়  ও পানি নেমে যাওয়ার সময় ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ প্রকট আকার ধারণ করে। সে সময় শিশু ও নারী ও বৃদ্ধারা বেশি বিপদে পড়েন। চিকিৎসা না পাওয়ায় দুর্ভোগ আর ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌছে। সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে শিশু ও গর্ভবতী মায়ের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, চর খিদিরপুরে সরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বেশির ভাগ সময় বন্ধ রয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকার পর একই বছর সেটি চালু হয়। কিন্তু নদী ভাঙনে সেটি ২০১৩ সালে বিলীন হয়ে যায়। এরপর নতুন জায়গায় কমিউনিটি ক্লিনিকের ঘর তৈরির উদ্যোগ নিলেও সেটির কাজ শেষ হয়নি। ফলে সেটি চালু করা সম্ভব হয়নি। নতুন এই ক্লিনিকের ঘরও নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। এটি সরে অন্য চরে নেওয়া হবে বলে জেনেছেন তারা ।

তারা জানান, তাদের চিকিৎসার জন্য রাজশাহী শহর থেকে অনেক দিন পরপর দুই-একটি টিম চরে আসে। তারা কিছু ওষুধপত্র দিয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিনে তাদের দেখা মিলে না। স্থানীয় খামারবাড়িতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর পক্ষ থেকে আগে কিছু ওষুধপত্র দেওয়া হলেও এখন সেটিও বন্ধ আছে। তাই তাদের ভরসা এখন স্থানীয় দুই গ্রাম্য চিকিৎসকের ওপরে। পারভেজ ও কোরবার নামের দুই ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও অভিজ্ঞতা থেকে স্থানীয়দের বিভিন্ন চিকিৎসা দেন।

চরখিদিরপুরে প্রথম আলোর ট্রাস্ট্রে পরিচালিত স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ে সখিনা খাতুন। চরে চিকিৎসক আছে কিনা? জানতে চাইতেই সখি বলে, আছে দুইজন ‘হাতুরে ডাক্তার’। এছাড়া চিকিৎসা দেওয়ার কেউ নেই।

লাকি বেগম বলেন, এখানে চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। চিকিৎসার জন্যে শহরে যেতে হয়। যার সামর্থ্য যেমন সেইভাবেই চিকিৎসা নেয়। গর্ভবতীদের সমস্যা চরম আকারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় দাই দিয়ে কাজ না হলে শেষ মুহূর্তে শহরে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় প্রায়শই মা অথবা বাচ্চার মৃত্যু ঘটে।

স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য কোহিনূর বেগম বলেন, চরে কোনো চিকিৎসা নেই। নদী পাড় হয়ে শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। নারী ও শিশুরা হঠাৎ অসুখ হলে বিপাকে পড়তে হয়।

স্থানীয় ৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, চিকিৎসা সেবা না পাওয়াই এখন চরের মানুষের এখন প্রধান। এখানকার মানুষেরা সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসাও ঠিকঠাক মতো পায় না। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারবার জানিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। আর কতবার বললো? এখানকার মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই জনপ্রতিনিধি।

গোলাম মোস্তফা জানান, এখানকার দুইজন ব্যক্তি গ্রাম চিকিৎসক হিসেবে একটু-আকটু প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। তারা এক সময় ওষুধের দোকানে কর্মচারীর কাজ করত। এখন তারাই ডাক্তার। আবার তারা আদায় করে দ্বিগুণ ফি। ১০ টাকার ওষুধ দিয়ে ৩০ টাকা, ৩০ টাকার ওষুধ দিয়ে ৫০টাকা নেয়। ওষুদের তো আর দাম করা যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়েও সেবা নেন স্থানীয়রা।

এ ব্যাপারে গ্রাম্য চিকিৎসক পারভেজ ও কোরবারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর পবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল ইসলাম বলেন, আমরা আন্তরিকতার সাথে তাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে পারি না।  শুধু সেখানকার মানুষদের শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

ডা. রেজাউলের দাবি প্রতি সপ্তাহে তাদের তিন সদস্যের টিম ওই চরে যায়। ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে তারা।

তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, দুই তিন মাস পর পর কিছু চিকিৎসক দল বেধে আসেন। একদিন চিকিৎসা দিয়েই ফেরত যান। যেটি ওই জনগোষ্ঠীর জন্যে খুবই অপর্যাপ্ত। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।