স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহতদের শহীদের মর্যাদা

স্বাধীনতা মানুষের অধিকার। সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় উভয় পথে চলার স্বাধীনতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মিথ্যা, মন্দ ও অন্যায় পথ পরিহার করে সত্য, ভালো ও ন্যায়ের পথে চলাই মনুষ্যত্ব। অনেক জাতি-গোষ্ঠীর মনুষ্যত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইনসাফের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম।

ইনসাফ ও ইসলাম : অন্যায়-অত্যাচার আর জুলুমের অবসান ঘটিয়ে সাম্য, ন্যায় ও  ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে। শিরক সবচেয়ে বড় অন্যায়, যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। মহান আল্লাহকে উপেক্ষা করে তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করা কখনো ইনসাফ ও যৌক্তিক হতে পারে না। এ জন্যই বলা হয়েছে, ‘ইন্নাশ শিরকা লাজুলমুন আজিম।’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই শিরক মহা জুলুম।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৩)

এ মহা জুলুমমুক্ত তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় সবশেষে প্রেরিত হয়েছেন মহানবী (সা.)। জুলুমমুক্ত ইনসাফের আলোয় উদ্ভাসিত মহানবী (সা.) যখন শৈশবে দুধমাতা হালিমা সাদিয়া (রা.) এর দুধ পান করেছিলেন তখনো তিনি শুধু নির্দিষ্ট একটি স্তন থেকেই দুধ পান করতেন। অন্য স্তনে কখনো মুখ দিতেন না। দুধ ভাই হালিমা সাদিয়ার পুত্র আবদুল্লাহর জন্য সেটি রেখে দিতেন। ইনসাফের আলো তখন থেকেই জ্বলতে শুরু করে।

ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম : ব্যক্তিত্বের সংশোধন ছাড়া সমাজ সংশোধন সম্ভব নয়। বিভিন্ন অঙ্গ-পত্যঙ্গের সমন্বয়ে একটি দেহ তৈরি হয়। সব অঙ্গ-পত্যঙ্গ সুস্থ ও নিখুঁত হলে সে দেহ নিখুঁত হয়। কাজেই ইনসাফভিত্তিক সমাজ গড়ার সদিচ্ছা থাকলে ব্যক্তিত্বের সংশোধনকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। ব্যক্তিত্বের সংশোধন, ন্যায় ও ইনসাফকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে হয়। ইনসাফপূর্ণ মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠিত হয়। তার পরও যখন এক শ্রেণির মানুষ ইনসাফকে ধ্বংস করতে অপতৎপরতা চালায়, তখন তাদের দমন করতে সংগ্রাম করতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছ না—দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান করুন—এখানকার আধিবাসীরা তো অত্যাচারী। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষালম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭৫)

ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় স্বাধীনতাসংগ্রাম : অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি, স্বাধীনতা অর্জন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামই হলো স্বাধীনতাসংগ্রাম। এ সংগ্রাম নিজের অধিকার আদায়ের জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য, দেশ ও জাতির মান-সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য। সর্বোপরি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও স্বাধীনভাবে বসবাস করে নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি পালনের জন্য। আল্লাহ তাআলা মানুষকে বাঁচার অধিকার দিয়েছেন। মানুষের সম্মান-সম্ভ্রম, সম্পদ ও প্রাণের নিরাপত্তা দিয়েছেন। শিক্ষা অর্জন, জীবিকা নির্বাহ, নিরাপদে চলাফেরা ও ইবাদত-বন্দেগি সম্পাদনের অধিকার দিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহরের মতো পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭)

অর্থাৎ আরাফাতের দিন, জিলহজ মাস ও মক্কা নগরী সবই পবিত্র। এ সময় ও স্থানে যেমন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করা বৈধ নয়, তেমনি কোনোভাবেই অন্যের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন করাও বৈধ নয়। অন্যের অধিকার, সম্পদ ও সম্মান নষ্ট করা যাবে না এবং পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। অথচ এক শ্রেণির মানুষ পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে। অন্যের ওপর অত্যাচার করে। ফলে মানুষ নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নিজের প্রাণ, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা থাকে না। স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হয়। তখন তাদের সঙ্গে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের বলা হয় যে দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না। তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করছি। মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী; কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২)

স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহতরা শহীদ : ইসলামে স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁরা নিহত হন তাঁরা শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। কারণ তাঁরা আল্লাহর দেওয়া অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে নিহত হয়েছেন। নিজের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করতে গিয়ে মারা গেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্পদ রক্ষার্থে নিহত হয় সে শহীদ।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৪৮; মুসলিম, হাদিস : ৩৭৮)। ব্যাপক অর্থে মানব জীবনে অর্জিত সম্পদ, বসতবাড়ি, দেশ, নিজের সম্মান ও মর্যাদা সবই সম্পদ। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে নির্যাতিত হয়ে যে নিহত হয়, সে শহীদ।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের উেস আছে নিজেদের অধিকার আদায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। কাজেই সব মানুষের অধিকার রক্ষা ও সমাজের সব স্তরে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম। আল্লাহ সে তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ