স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা স্থগিত

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে পড়ে প্রকাশের চার দিনের মাথায়ই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালালদের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ তালিকা স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পর মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তালিকাটি। রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানায়, আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সংশোধিত তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনের পর নতুন করে তালিকাটি প্রকাশ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন বলে গতকাল সকালেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সন্ধ্যায় গণভবনে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যদি রাজাকার বলা হয়, এর চেয়ে কষ্টের ও দুঃখের কিছু থাকে না।’ প্রকাশ হওয়া তালিকা কোনোভাবেই রাজাকারের তালিকা নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি একটা কথা স্পষ্ট বলে দিতে চাই, কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার খেতাব দেওয়া হবে না, হতে পারে না। এটা অসম্ভব। অন্তত আমার সময় না। এটা কোনো দিন আমরা হতে দেব না।’

স্বাধীনতার ৪৯তম বছরে এসে গত ১৫ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকায় জীবন বাজি রেখে যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের নাম, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শহীদ পরিবারের সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত দেখে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। কোথাও কোথাও বিক্ষোভও হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায়, কেন এই ত্রুটিপূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হলো, সে প্রশ্নও উঠেছে।

এই প্রেক্ষাপটেই গতকাল রাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রকাশিত তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকা প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল হতে অভিনন্দিত করা হয়েছে, আবার তালিকায় কিছু ভুলত্রুটির জন্য তীব্র সমালোচনাও হয়েছে। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির মধ্যে যাতে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি না হয় সে জন্য প্রকাশিত তালিকা স্থগিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।’

বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ তালিকা যাচাই-বাছাই করে সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কী প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে দেশব্যাপী যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করা যায় সে ব্যাপারে বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনা প্রয়োজন। আগামী ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এ তালিকা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকবে।’

বিতর্কিত তালিকা স্থগিতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ড. এম এ হাসান। তিনি গত রাতে  বলেন, ‘আশা করি তালিকাটি ত্রুটিমুক্ত করে প্রকাশ করা হবে। তবে এই তালিকায় কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এসেছিল, সরকারের একটি উদ্যোগকে নস্যাৎ করার জন্য কেউ এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।’

ড. এম এ হাসান যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি দল, সংগঠন, বাহিনী—রাজাকার, আলবদর, আলশামস, আল মুজাহিদী ও শান্তি কমিটির পৃথক পৃথক তালিকা তৈরি করার আহ্বান জানান। এই তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদেরও সম্পৃক্ত করার দাবি জানান তিনি।

তালিকা প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তালিকাটি ১৯৭১ সালে করা। এটা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করে শুধু প্রকাশ করেছি। ভুলত্রুটি বেশি বের হলে তালিকা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।’ অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, স্বাধীনতার পর দালাল আইনে হওয়া আসামিদের তালিকা তাঁর দপ্তর থেকে নোটসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। নোটে যেসব ব্যক্তির নাম-মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল, তার উল্লেখ ছিল। কিন্তু তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই সব নোট বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

তালিকা সংশোধনের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে এবং বিষয়টি আমাদের নেত্রী এরই মধ্যে জানেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যাচাই-বাছাই করে এখানে যেন ভুলভ্রান্তি না থাকে, ভুলভ্রান্তি থাকলে সংশোধন করে তালিকা প্রকাশের নির্দেশনা দিয়েছেন।’

‘কারসাজি করে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম’ : আমাদের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে বিজয় মেলা মাঠে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ওরা (বিএনপি-জামায়াত সরকার) ২৪-২৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় হয়তো বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রাখা কাগজপত্র কারসাজি করে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিখে রেখেছে। এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। সে কারণে ভুলটা হয়ে গেছে। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকলে আমরা অচিরেই যাচাই-বাছাই করে সে নামগুলো প্রত্যাহার করে নেব। তবে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের নাম থাকবেই। পরবর্তীতে যে তালিকা প্রকাশ করা হবে, সেগুলো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে উদ্ধার করে পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘এই তালিকায় ইচ্ছাকৃত ভুল ছিল না। রাজাকারদের তালিকায় যাদের নাম ছিল, তা সঠিক ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়েছিল। এ কারণে যাচাই-বাছাই না করেই তালিকা প্রকাশ করায় আমরা এই হোঁচট খেয়েছি। কাজ করতে গেলে ভুল তো হতেই পারে। ৬৪ জেলার ৪৬০টি উপজেলার যে সম্পূরক তালিকা আসবে, পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে সেই তালিকা প্রকাশ করা হবে। ত্রুটিপূর্ণ তালিকা মন্ত্রণালয়ের নিজ উদ্যোগে সংশোধন করা হবে।’ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমি জানি, বল্লার (মৌমাছি) চাকে আমি হাত দিয়েছি। রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের তালিকা প্রকাশ করেছি। সংগত কারণেই একটা বিশেষ শ্রেণি ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ৪৮ বছর পর রাজাকারদের তালিকা করার কী দরকার? তারা তো বলবেই। কারণ, তাদের আঁতে ঘা লাগে।’

তিন দপ্তরে গোলাম আরিফ টিপুর চিঠি : স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম আসায় ওই তালিকা সংশোধন, প্রত্যাহার ও বাতিল চেয়ে তিন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল স্বরাষ্ট্র, আইন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এ আবেদন করা হয়।

প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম গণমাধ্যমকে জানান, এই তালিকা সংশোধন, বাতিল ও প্রত্যাহার চাওয়া হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কাছে। পাশাপাশি যেসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তার অনুলিপি চাওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ : আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের পরিচালক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ মির্জার নাম ‘রাজাকারের তালিকা’য় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। এ ছাড়া সকালে সিরাজগঞ্জ শহরের চৌরাস্তা মোড়ে লতিফ মির্জা স্মৃতি পরিষদ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে।

তালিকায় বরগুনা পাথরঘাটার মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজিবুল হক ‘নয়াভাই’র নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রতিবাদে বরগুনার বামনায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ও প্রেস ক্লাব সদস্যরা।

তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসার প্রতিবাদ এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি। নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এ কর্মসূচিতে বিশিষ্টজনরা অংশ নেন।

ঝালকাঠি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রাজাপুরের সন্তান সৈয়দ শামসুল আলম এবং রাজাপুর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য এনায়েত হোসেন খান মিলুসহ পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঝালকাঠি ও রাজাপুরের মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে রাজাপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।