সোনালী ব্যাগ: বিপুল সম্ভাবনা, মনোযোগ কম

ডেমরায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লতিফ বাওয়ানী জুট মিলসে স্থানীয়ভাবে তৈরি দুটি মেশিনে সোনালী ব্যাগের উৎপাদন চলছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১৫ হাজার পিস ব্যাগ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে ব্যাগটির চাহিদা উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।

২০১৫ সালে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালী ব্যাগ’ তৈরি করেন ড. মোবারক আহমেদ খান। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যাগের জায়গা নেওয়ার বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বায়োডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগ। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও এই আবিষ্কারের সুফল ঘরে তুলতে পারেনি।

বিশ্বব্যাপী সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের শপিং ব্যাগের বাজার রয়েছে। তাছাড়া অনেক দেশই এখন পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিংয়ের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এই বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগের স্থানীয় চাহিদার এক-তৃতীয়াংশই পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ, রপ্তানি তো অনেক পরের কথা।

সোনালী ব্যাগের ভালো চাহিদা তৈরি হওয়া সত্ত্বেও বড় বিনিয়োগ ও উন্নত যন্ত্রের অভাবে ব্যাপকভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)।

ডেমরায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন লতিফ বাওয়ানী জুট মিলসে স্থানীয়ভাবে তৈরি দুটি মেশিনে সোনালী ব্যাগের উৎপাদন চলছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১৫ হাজার পিস ব্যাগ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে ব্যাগটির চাহিদা উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি।

বিজেএমসি কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরিবেশবান্ধব ব্যাগটি বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন করতে যেসব যন্ত্রপাতি বা মেশিন প্রয়োজন তা বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠানই উৎপাদন করে না। মেশিনের নমুনা চাহিদাপত্র দিলে তৈরি করতে পারবে বলে জানিয়েছে চীন, জার্মানি ও আমেরিকার কয়েক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

বিজেএমসির চাহিদা অনুযায়ী চীনের একটি কোম্পানি মেশিন তৈরির কাজ করছে। এ মেসিন আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে দেশে আসতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা।

বর্তমানে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো, বস্ত্রখাতের প্রতিষ্ঠান সারা লাইফস্টাইল, রহিম আফরোজ ও গো-গ্রিনসহ আরও কয়েকটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান বিজেএমসির কাছ থেকে সোনালী ব্যাগ কিনছে।

সিঙ্গার বাংলাদেশও তাদের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের র‍্যাপিংয়ের জন্য পরিবেশবান্ধব ব্যাগটি ব্যবহার করতে আগ্রহী। সেই অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বিজেএমসির কাছ থেকে নমুনাও নিয়ে তাদের মাদার কোম্পানির কাছে পাঠিয়েছে। এখন তাদের মাদার কোম্পানির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে বিজেএমসি সূত্র।

ব্যাটারি উৎপাদনকারী রহিম আফরোজ (বাংলাদেশ) লিমিটেড অগ্রিম টাকা দিয়ে বেশি পরিমাণে ব্যাগ নিতে চাইলেও সীমিত উৎপাদন সক্ষমতার কারণে তা এখনো দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বিজেএমসি সূত্র।

এছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণবাদী গোষ্ঠী গো-গ্রিনসহ কিছু অনলাইন প্রতিষ্ঠান বিজেএমসির কাছ থেকে প্রতিটি ব্যাগ ১০ টাকা করে কিনে ১৫ টাকা করে বাজারে বিক্রি করছে।

বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ও সোনালি ব্যাগের উদ্ভাবক ড. মোবারক আহমেদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘রহিম আফরোজ আগে কয়েকবার ব্যাগ নিয়েছে। এখন আরও বেশি পরিমাণ ব্যাগ নিতে চায়। প্রয়োজনে অগ্রিম টাকাও দিতে রাজি প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা না থাকায় ব্যাগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

২০১৫ সালে ড. মোবারক সোনালী ব্যাগ আবিষ্কার করেন।

এরপর বিজেএমসি ২০১৭ সালে ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলসে পাইলট প্রকল্পের আওতায় পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে সোনালী ব্যাগ উৎপাদন শুরু করে।

পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পর, পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে, সোনালী বহির্বিশ্বে নজর কারে।

আবিষ্কার ও সফল পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পরও বৃহৎ পরিসরে এই বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগের উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

ড. মোবারক জানান, সোনালী ব্যাগ বাজারজাতকরণে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট-এর (বিএসটিআই) অনুমোদন পাওয়া গেছে।

এছাড়াও ব্যাগটির পচনশীলতা (বায়োডিগ্রেবিলিটি) পরীক্ষা করে দেখেছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি নামে পরিচিত বাংলাদেশ কাউন্সিল অভ সায়েন্তিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)।

২০১৭ সালে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেমি-পাইলট প্রকল্প হাতে নেয় বিজেএমসি। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সোনালী ব্যাগ নিয়ে অধিকতর গবেষণায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার অনুদান দেয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সোনালী ব্যাগের উদ্ভাবনটির সফল হওয়ার মতো কার্যকারিতা এখনও দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে ব্যাগটি দ্রুত বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ উদ্ভাবনটি এগিয়ে নিতে পৃথক কোনো ব্যবস্থাপনা বা তহবিলেরও ব্যবস্থা করা হয়নি।

অন্যদিকে প্রচলিত পলিথিনের তুলনায় সোনালী ব্যাগের দামও বেশি। এটিও সোনালী ব্যাগকে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়যোগ্য করার একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এ বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, ‘এই বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু কমার্শিয়াল ভায়াবিলিটির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পলিথিনের চেয়ে এর দাম বেশি।’

তিনি আরও বলেন, সোনালী ব্যাগকে বাণিজ্যিকীকরণের মূল চ্যালেঞ্জ হলো সরকারি ব্যবস্থাপনা। এজন্য দ্রুত এর বাণিজ্যিকীকরণে সরকারি-বেসরকারি যৌথভাবে কাজ করা যেতে পারে মত দেন তিনি।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল মান্নান টিবিএসকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাগের সম্ভাবনা থাকলেও আমরা সেটাকে এখনো ভালোভাবে এগিয়ে নিতে পারিনি। এটাকে এগিয়ে নিতে পারলে সরকারি পাটকলগুলোকে কাজে লাগাতে পারতাম।’

তবে বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ দাবি করেন তারা জোরেশোরেই সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিকীকরণের পথে হাঁটছেন।

কিন্তু পপ্রকৃতপক্ষে বছর দুয়েক আগেও বাণিজ্যিকীকরনের জন্য কখনও ১৫০ কোটি, কখনও ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়ার জন্য ফাইল চালাচালি হয়েছে। তবে এখনও বড় কোনো প্রকল্প নেয়ার পরিকল্পনা বা কার্যক্রম বিজেএমসিতে নেই।

মো. আবদুর রউফ জানান, ‘পণ্যটি নতুন হওয়ায় এর মানোন্নয়নে এখনো গবেষণা চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে মেশিনারিজসহ কিছু সমস্যা সমাধান করে বাণিজ্যকভাবে উৎপাদনের পথেই এগোচ্ছি। এর জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখনও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেশিনারিজ তৈরির জন্য চেষ্টা করে যাওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার আগে পণ্যটির যেসব বিষয়ে সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো সমাধান করার আগে বড় ইনভেস্টমেন্টে যাওয়া যাচ্ছে না।’- দি বিজনেস স্ট্যান্ডাট