সুবিধাবাদীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে

দেশের পুরনো একটা টিভি চ্যানেলে টকশো চলছিল। আলোচনায় অংশ নেয়া একজন রাজনৈতিক কর্মীর বক্তব্যে চমকে উঠেছিলাম। তিনি দাবি করে বসলেন- সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর নিকটতম আত্মীয়ের অনেক সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে বিদেশি একটি রাষ্ট্র। সরকারদলীয় নন এমন একজন আলোচক এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, তার এসব তথ্যের ভিত্তি কী?

খানিকটা ইতস্তত করে ভদ্রলোক বললেন, অনলাইন একটি পোর্টাল। প্রতিবাদকারী আলোচক তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন: তথ্যসূত্র যাচাই না করে এমন মানহানিকর বক্তব্য পাবলিক ডোমেইনে ছড়িয়ে দেয়া দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। তিনি এ-ও বললেন, যতদূর তিনি জানেন, আলোচিত ভদ্রলোক দেশের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী, বিদ্বান ও সজ্জন বলে সর্বত্র সমাদৃত।

অভিযোগকারী আলোচকের চোখে-মুখে লজ্জা বা অনুতাপের লেশমাত্র লক্ষ করিনি। বরং একধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি বলে গেলেন, শেখ মুজিবই প্রথম এ দেশে ইনডেমনিটি আইন বলবৎ করেছেন। এবার কিছুটা স্পষ্ট হল তথ্যের যথার্থতা বা সঠিকতা নিয়ে ভদ্রলোকের কোনো মাথাব্যথা নেই। এটি ’৭৫-পরবর্তী গৎবাঁধা অপপ্রচারের পুরনো অভ্যাস।

বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, দেশ যখন মুজিববর্ষের আবহে উষ্ণ, তখন জাতির পিতা সম্পর্কে এমন ভিত্তিহীন ও শ্রদ্ধাহীন বক্তব্য আলোকতরঙ্গে ভাসিয়ে দেয়া সম্ভব।

নিরপেক্ষতা নিঃসন্দেহে এক দুর্লভ মানসিক সক্ষমতা। মানুষ আসলে কী শুনতে চায়, কী পড়তে চায়, আদৌ সে সত্যের মুখে দাঁড়াতে চায় কি না, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনের ধাঁচ ও চাহিদার ওপরই অনেকটা নির্ভর করে; স্বার্থ সেখানে নিয়ামক সন্দেহ নেই। আর লক্ষ্যভেদে সফল হলে তখন বিভিন্ন প্রবৃত্তিকে সন্তুষ্ট করার তাড়না জাগে।

মিথ্যা জানা সত্ত্বেও তা প্রচার হতে দেয়া বা প্রচার করা একটি অদ্ভুত মানসিক দ্বন্দ্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব। আগস্টজুড়েই বঙ্গবন্ধু হত্যা, একুশ আগস্ট কিংবা জেলহত্যার ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রের ভূমিকা, বিদেশি রাষ্ট্রের সক্রিয়তা এবং ঘটনার ভয়াবহতাকে আড়াল করার পরিকল্পিত অপচেষ্টা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে আলোচনা হয়েছে।

একজন নিরপেক্ষ বলে পরিচিত বিশ্লেষকের মতে, এ দেশের ঐতিহ্যের মাঝেই প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতা নিহিত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো চরম প্রতিহিংসামূলক বর্বরতার পাশাপাশি কিছু বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতেরও দৃষ্টান্ত আছে। এ ঘটনাগুলোকে একই দৃষ্টিকোণে বিচার করলে তা উদ্দেশ্যমূলক সরলীকরণ বলে মনে হতে পারে।

শুধু ১৫ ও ২১ আগস্ট বা ৩ নভেম্বর নয়; মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এমন অনেক মহৎপ্রাণ শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক হত্যার সাক্ষী হয়েছে নিকট অতীত। ইতিহাস বলে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধী সবুর খান, শাহ আজিজ কিংবা ফকা চৌধুরীকে নিশ্চিহ্ন করেননি।

অথবা বিচারবহির্ভূত কোনো পন্থায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী, ২১ আগস্টের ঘাতক কিংবা জঙ্গিবাদীদেরও শাস্তি পেতে হয়নি। নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার অভিমুখ সব সময় একদিকেই নিবদ্ধ ছিল।

ভাবলে অবাক লাগে, এ জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আজও কুৎসা ছড়ানো সম্ভব। কখনও হত্যার পটভূমি নির্মাণের ছলে, কখনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। দুর্জনের ছলের কোনো অভাব হয় না। মিথ্যা বুননের এমন কারুকার্য আমাদের রাজনীতির ক্যানভাসে এখন বেশ গা-সওয়া। বুঝে নিতে তাই কষ্ট হয় না ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম কেন মুখে আনা যায়নি; বা নতুন প্রজন্ম জাতির এ মহানায়ককে কেন জানতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর (অব.) রশিদ একটি টিভি চ্যানেলে লাইভ সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছিল- ‘শেখ মুজিবকে বিচার করে শাস্তি দেয়া সম্ভব ছিল না; কারণ জনতাকে উত্তেজিত করার এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তার। তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমাদের হাতে ছিল না।’

খুনির অকপট এ দম্ভোক্তি বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলো সামনে চলে আসে তা হল প্রথমত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একটি বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির সন্ত্রাসী প্রতিহিংসা, যার নেপথ্যে কোনো বিপ্লবের উপাদান ছিল না। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বিপুল জনপ্রিয়তা তার ঘাতকচক্রকে সব সময় তটস্থ করে রেখেছিল।

তৃতীয়ত, সভ্যতার এ ভয়ানক স্খলনকে রাষ্ট্র নামক সভ্য খোলসের মোড়কে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিচ্যুতিকে মদদ জুগিয়েছিল বলে মনে হয়। চতুর্থত, অত্যন্ত সংগঠিতভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টি ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত ইতিহাস জানতে বাধ্য করা হয়।

পঞ্চমত, তারা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধু ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তির দর্শনটাকেই বদলে দেয়া যাবে, যা আদৌ সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিল কি না, তা কৌতূহলের বিষয় হয়ে থাকবে। ষষ্ঠত, আওয়ামী লীগ বা সরকারের বেনিফিশিয়ারিদের বড় অংশই বাকশাল ধারণার পুনরুজ্জীবন বা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে যথেষ্ট আন্তরিক ছিল বলে মনে হয় না।

মুক্তিযুদ্ধের তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার কার্যকর হয়েছিল, যা যুদ্ধ-সংস্কৃতির সমকালীন বা প্রাচীন ইতিহাসেও নজিরবিহীন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নসহ ১২৬টি দেশের স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হয়েছিল বিস্ময়করভাবে। ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন, ভুট্টো ঢাকা সফর করেছিল।

পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালি সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনাকেই বঙ্গবন্ধু অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের মর্যাদাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোও জাতির পিতাই তৈরি করে দিয়েছিলেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বঙ্গবন্ধুই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এত কিছুর পরও ২১ বছরজুড়ে বঙ্গবন্ধুর গায়ে ভারতপ্রীতি ও ইসলামবিদ্বেষের দাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি ভাবাদর্শ, আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতা সমাজে এমনভাবে গেড়ে বসে, যা পাকিস্তান আমলেও চোখে পড়েনি। পাকিস্তানি ক্রিকেট, পাকিস্তানি পোশাক, পাকিস্তানি ভাবধারা প্রচারের কুশলী চেষ্টা অব্যাহত থাকে।

সমাজের অভ্যন্তরে ধর্মীয় মেরুকরণের এক দৃষ্টিকটু চেহারা প্রকাশ পেতে আরম্ভ করে। লক্ষণীয় দিক হল ১৯৯১ সালের নির্বাচন, যখন বিএনপি ছিল অসংগঠিত, দুর্বল, অনেকটাই দিশাহীন; তবু দলটির বিজয় যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ।

সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, অর্থ আর ভারতবিদ্বেষই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা হয়তো কার্যত পাকিস্তানি ভাবধারায় সামাজিক মেরুকরণের সূচনা ঘটায়। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেছিল কি না-ভবিষ্যতে তা আগ্রহের বিষয়বস্তু হতে পারে।

এ-ও সত্য, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ সংগঠিত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কোনো আদর্শিক প্রতিরোধ তৈরি করতে চেষ্টা করেনি। তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টি বা পাল্টা যুক্তি দেয়ার জন্য কোনো যৌক্তিক কাঠামোও সৃষ্টি হয়নি। বরং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এ দলের বৃহৎ অংশটি তাত্ত্বিক বা মানসিকভাবেও খুবই ভঙ্গুর।

সুবিধাবাদী, অন্তঃসারশূন্য একদল দিকভ্রষ্ট মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ হতে পারে। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। মনেপ্রাণে কতজন তা বিশ্বাস করে তা বোঝাও কঠিন। দলনেত্রীর প্রশংসার বৃত্তেই এদের ঘোরাফেরা, এদের স্বস্তি, এদের ভরসা।

ক্ষমতার আশপাশে যেসব দলীয়কর্মী বা পেশাজীবীকে দেখা যায়, তারাও মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেন কি না, এ বিষয়ে ঘোর সংশয় আছে। বিশেষ করে ছাত্র-যুব শ্রেণির মধ্যে যে ক্ষুদ্রগোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, তারাও এখন নানা কারণে কোণঠাসা। দলের অভিজ্ঞ অংশেও যারা তৎপর ছিলেন, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। তাহলে আদর্শ বাঁচবে কী করে?

একজন ভাইস চ্যান্সেলর কথাচ্ছলে যুবলীগের সভাপতি হতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গেল। কী আশ্চর্য কথা! তাহলে রাজনীতি করবে কারা? আমলা, ব্যবসায়ী, জালিয়াত, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী, না সুযোগসন্ধানী-ভেবে দেখতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দলকে আদর্শিকভাবে বুদ্ধি আর যুক্তির শৃঙ্খলে গোছাতে হবে।

খেয়াল করে দেখেছি, বিশেষ করে ’৫৮ সালের পর থেকে বঙ্গবন্ধু এমন কিছু তাত্ত্বিক গবেষক, নিখাদ রাজনৈতিক বোদ্ধাকে নিয়ে একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছিলেন, যেখান থেকে তিনি সার্বক্ষণিক সৎ পরামর্শ পেতেন। ক্ষমতার কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল কি না, সেটিও ইতিহাসের বিবেচ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলে এমন কোনো গবেষক সেলের অস্তিত্ব অনুভূত হয় না। ফলে সুবিধাবাদী আমলা, মুনাফাকামী ব্যবসায়ী বা একশ্রেণির বেপরোয়া দুর্বৃত্তই দলকে ঘিরে রেখেছে কি না, বোঝা যায় না।

পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পরিচিত কিছু নামকরা স্বাধীনতাবিরোধী মুখকে আবার দেখা যাচ্ছে। তারা পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে প্রচার মাধ্যমের চিহ্নিত পকেটগুলোয়। তারা লজ্জা, ভয় ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধ, দেশবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। কৌশলের মুখোশ হল নেত্রীর জন্য মায়াকান্না। সামান্য শ্রদ্ধা যদি জাতির পিতা বা তার পরিবারবর্গের জন্য অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তার হত্যাকারী বা জীবননাশী শক্তির পক্ষে তাদের অবস্থান কেন?

এদের দরদ দেখে বঙ্গবন্ধুর জন্য খুনি মোশতাকের কান্নাকাটির কথা মনে পড়ে। আওয়ামী লীগ কেন দেশি-বিদেশি এসব চক্রের অপতৎপরতার জাল ছিঁড়ে ফেলতে পারছে না?

নাকি সেখানেও ভূত এসে ঢুকেছে? বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যেসব দেশে পালিয়ে আছে, সেখানে আমাদের দূতাবাসের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ব্যতিক্রম শুধু তারুণ্য। এ তারুণ্যকেই নানা অপবাদে জড়িয়ে প্রান্তিক করে ফেলা হয়েছে, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ যদি ইতিহাস বিচার করে, নিশ্চিতভাবেই উঠে আসবে ২১ আগস্টের হিংস্র প্রতিহিংসা ও এর যৌক্তিক অভিঘাত। আর নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছিল এ বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। এটাই জনতার আদালত। কে দায়ী, কারা দায়ী, কতখানি দায়ী-এসব বিচার করবেন বিজ্ঞ আদালত। কিন্তু জনতার দৃষ্টি গভীরপ্রসারী।

সেখানে ভ্রান্তি নেই, তা নয়; তবে তা নিতান্তই সাময়িক। যেমন, ’৭৫-পরবর্তী পারিপার্শ্বিকতাও ঘটনাপ্রবাহের গতিকে প্রভাবিত করেছিল। আওয়ামী নেতৃত্ব, আমলাতন্ত্র, সুশীলসমাজ, পেশাজীবী, সাংবাদিক-সবাই ছিল নির্লিপ্ত ও আপসকামী। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বিদ্রোহ, যা বঙ্গবন্ধুর অগণিত শোকস্তব্ধ সমর্থকের মনে সামান্য হলেও সান্ত্বনার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল।

বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড কিংবা জঙ্গি তৎপরতায় অভিযুক্তদের বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করতে দেশের ভেতরে বা বাইরে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সক্ষমতার অভাব চোখে পড়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এ ক্ষেত্রে হয়তো একমাত্র ব্যতিক্রম। বিভিন্ন সময় রাজধানীতে জঙ্গিরা প্রশ্রয় পেয়েছে, অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিতে পেরেছে।

এমনকি আফগানিস্তান, কাশ্মীর বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও নানাভাবে এসব অপরাধী চক্রের সঙ্গে এক সময় আঁতাত গড়ে তুলেছিল, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি প্রমাণিত হয়েছে। সামান্য অসতর্কতায় এরা আবার সক্রিয় ও সংগঠিত হয়ে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে এখনও সক্ষম বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।

বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জোরালো সমন্বয় দরকার। প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কোনো রকম বোধগম্য দূরত্ব যে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিককে হতাশ করে। দল, প্রতিষ্ঠান-সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশ। কোনো পক্ষ থেকেই এমন কোনো আচরণ বা কথাবার্তা সঙ্গত হবে না, যা জনমনে উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রেই চাই দায়িত্বশীলতা।

এমন এক অস্থির সময়ে, এমনকি মহামারীকালেও যেভাবে লাগামহীন দুর্নীতির আস্ফালন ঘটছে, তা শুধু লজ্জার নয়, রহস্যজনকও বটে। সাম্প্রতিকালে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে নাগরিক মানসে এক ধরনের বৈষম্যের ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। ন্যায়বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার মতো অধিকারের বৃত্তে সব নাগরিকের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণি অন্যের চেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত- এমন অসাম্যের বোধ যাতে সরকার ও জনগণের মাঝে কোনো দূরত্ব তৈরি করতে না পারে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে। শক্তিশালী সংগঠনের প্রাণশক্তিই হল এমন নিবেদিত কর্মী, যারা ক্ষমতার বলয়ে যায় না। সংকটের ঘোর অমানিশায় তারাই অতন্দ্র প্রহরী, ভরসার বাতিঘর।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নানা ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধুর পাশে যেমন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ বা সিরাজুল আলম খানের মতো ত্যাগী ও মেধাবী রাজনৈতিক কর্মী; বর্তমান নেতৃত্বের পাশেও আজ এমন দক্ষ সংগঠক প্রয়োজন, যারা তারুণ্যনির্ভর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করবে আদর্শ, নীতি ও মেধার আলোয়-যা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব অন্যায়, সব ষড়যন্ত্র।

অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ

principalffmmc@gmail.com

 

সূত্রঃ যুগান্তর